বিশ্ব

সাত মাস ঘোড়ার পিঠে চড়ে মক্কায় হাজির ৩ স্প্যানিশ

একবিংশ শতাব্দীর প্রযুক্তিপূর্ণ বিশ্বে যেখানে বিমানে করে কয়েক ঘণ্টায় হজ পালনের লক্ষ্যে মুসলিমরা সৌদি আরবে পৌঁছাতে পারেন, সেখানে তিন স্প্যানিশ মুসলিম চমকপ্রদ ও ঐতিহাসিক এক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তারা ঘোড়ার পিঠে চড়ে প্রায় সাত মাস ধরে সাড়ে ছয় হাজার কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে স্পেনের আন্দালুসিয়া থেকে ইসলামের পবিত্র শহর মক্কায় পৌঁছেছেন। তাদের এ ব্যতিক্রমী যাত্রা শুধু শারীরিক ও মানসিক দৃঢ়তার নিদর্শনই নয়, বরং শতাব্দীপ্রাচীন মুসলিম ঐতিহ্য ও আত্মপরিচয়ের সঙ্গে গভীর এক আত্মিক সংযোগের বহিঃপ্রকাশও বটে।

ঐতিহাসিক পথ ধরে নতুন অভিযাত্রা

আবদেলকাদির হারকাসি আইদি, তারেক রদ্রিগেজ ও আবদাল্লাহ রাফায়েল হেরনান্দেজ মানচা—এই তিন সাহসী অশ্বারোহী ছিলেন ‘আন্দালুসিয়ান হজ রাইড’ নামের একটি প্রকল্পের অংশ, যার মূল উদ্দেশ্য ছিল ঘোড়ায় চড়ে হজ সম্পন্ন করা এবং মুসলিম ঐতিহ্যবাহী ভ্রমণপথে নবজাগরণ ঘটানো। এই যাত্রার সূচনা হয়েছিল ২০২৪ সালের অক্টোবরে স্পেনের দক্ষিণাঞ্চলের আলমোনাস্তার লা রিয়াল এলাকার একটি ঐতিহাসিক মসজিদ থেকে। এই মসজিদটি আন্দালুসীয় মুসলিম ঐতিহ্যের এক জীবন্ত সাক্ষী, এবং এখান থেকেই তাদের হজযাত্রার সূচনা অত্যন্ত প্রতীকী।

প্রায় ৫০০ বছর আগে মুসলিমরা এ পথ ধরে হজে যেতেন। সেই ঐতিহ্যের পুনর্জাগরণ ঘটিয়ে তিন স্প্যানিশ মুসলিম নিজেদের বিশ্বাস, সংস্কৃতি ও আত্মপরিচয়ের শক্ত বার্তা তুলে ধরেছেন পুরো মুসলিম বিশ্বের সামনে।

দীর্ঘ প্রস্তুতি ও কঠিন বাস্তবতা

এই অস্বাভাবিক যাত্রার পেছনে ছিল দীর্ঘ চার বছরের প্রস্তুতি। ঘোড়া চালানো শেখা, খুজেস্তানি প্রজাতির উপযুক্ত ঘোড়া সংগ্রহ, শারীরিক প্রশিক্ষণ এবং অর্থ সংগ্রহ—সবকিছুই ছিল একটি বৃহৎ পরিকল্পনার অংশ। যাত্রা শুরুর পর প্রতিদিন গড়ে ৪০ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করেছেন তারা। পথে নিজ হাতে রান্না করা, রাতের ঘুম তাঁবুতে—এ যেন প্রাচীন হজযাত্রীদের জীবন্ত চিত্র।

তবে সবকিছু এতটা সহজ ছিল না। মোহাম্মদ মেসবাহি নামে তাদের একজন সঙ্গী যাত্রার শুরুর দিকেই ঘোড়ার অসুস্থতার কারণে ফিরে যেতে বাধ্য হন। অর্থনৈতিক সংকটও তাদের বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। এক পর্যায়ে তারা ইউরোপের বিভিন্ন দেশে স্থানীয় জনগণের দান ও সাহায্যের ওপর নির্ভর করতে শুরু করেন।

ফ্রান্স ও ইতালির বিভিন্ন ইকুয়েস্ট্রিয়ান সেন্টারে তারা আশ্রয় নিয়েছিলেন। ইতালির ভারোনায় সৌদি স্ন্যাপচ্যাট ইনফ্লুয়েন্সার আবদুর রহমান আল-মুতাইরি তাদের একটি ক্যারাভান উপহার দেন। সেই ক্যারাভান তাদের শীতপ্রধান অঞ্চল ক্রোয়েশিয়া পাড়ি দিতে অনেক সহায়তা করে। এছাড়াও একটি সহায়ক গাড়ি ছিল তাদের সঙ্গে, যাতে তাদের রসদ ও প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র বহন করা হতো।

বিশ্বাস ও সংকল্পের প্রতীক

এই অভিযাত্রা কেবল এক ধর্মীয় রীতির অনুসরণ নয়; বরং এটি বিশ্বাস, ধৈর্য, আত্মত্যাগ ও মুসলিম পরিচয়ের একটি জীবন্ত উদাহরণ। হেরনান্দেজ মানচা, যিনি ছিলেন একজন ইতিহাসের শিক্ষক, ৩৬ বছর আগে ইসলাম গ্রহণের প্রতিজ্ঞা করেছিলেন। সেই প্রতিজ্ঞা পূরণেই তিনি এই দীর্ঘ ও কষ্টসাধ্য যাত্রায় অংশ নেন। তার ভাষায়, ‘‘এই যাত্রা ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের বাস্তব প্রতিফলন।’’

যাত্রাপথে তারা তুরস্ক, সিরিয়া, জেরুজালেম, জর্ডান হয়ে সৌদি আরবে প্রবেশ করেন। সৌদি আরব পৌঁছানোর পর প্রশাসনিক জটিলতা দেখা দেয়। নিরাপত্তার খাতিরে তাদের ঘোড়াগুলো রিয়াদে রেখে মদিনায় যেতে বলা হয়। সৌদি কর্তৃপক্ষ তাদের বিশেষ ফ্লাইট ও বিলাসবহুল আতিথেয়তায় মদিনা নিয়ে যায়। এরপর তারা মদিনা থেকে মক্কায় পৌঁছান এবং হজ পালন করেন।

মক্কায় পৌঁছে এক আবেগঘন মুহূর্ত

হজের মূল গন্তব্যে পৌঁছে তারা গভীর আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়েন। হারকাসি আইদি বলেন, “এটা ছিল অসম্ভব এক যাত্রা, যা আল্লাহর ইচ্ছাতেই সম্ভব হয়েছে। আমরা শুধু হজ করতেই আসিনি, বরং স্প্যানিশ মুসলিমদের আত্মপরিচয় ও সংস্কৃতির প্রতিনিধিত্ব করতেও এসেছি।”

তাদের এই যাত্রা শুধুমাত্র স্পেন নয়, বরং পুরো মুসলিম বিশ্বে ব্যাপক আলোড়ন তুলেছে। বহু মানুষ তাদের সাহস, সংগ্রাম এবং আত্মনিবেদনে অনুপ্রাণিত হয়েছেন।

যাত্রার শেষ ও অমলিন স্মৃতি

অসাধারণ এই অভিযাত্রার একটি দুঃখজনক দিকও রয়েছে। মক্কায় পৌঁছানোর পর জানা গেছে, তাদের সঙ্গী ঘোড়াগুলো আর স্পেনে ফিরে যাবে না। যেহেতু দীর্ঘপথ পাড়ি দেওয়ার পর ঘোড়াগুলোর শারীরিক অবস্থা আর আগের মতো নেই, তাই তাদের উন্নত রক্ষণাবেক্ষণের জন্য সৌদি আরবেই রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এসব ঘোড়াকে সংরক্ষণ ও সেবা দেওয়ার জন্য একটি বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে বলে জানা গেছে।

যদিও ঘোড়াগুলো ফিরে যাবে না, তবে এই যাত্রা এবং স্মৃতিগুলো তাদের জীবনে অমলিন হয়ে থাকবে। এই অভিযান ভবিষ্যতের জন্য একটি অনুপ্রেরণা হিসেবে থাকবে এবং দেখিয়ে দেবে যে, আত্মিক লক্ষ্য ও বিশ্বাস যদি অটুট থাকে, তবে কোনো পথই অসম্ভব নয়।

উপসংহার

আবদেলকাদির, তারেক ও হেরনান্দেজ মানচার এই যাত্রা আধুনিক সময়ে এক অনন্য দৃষ্টান্ত। একদিকে এটি প্রযুক্তির বাইরে গিয়ে মানবিক ধৈর্য, প্রস্তুতি ও আত্মার শক্তিকে তুলে ধরেছে, অন্যদিকে মুসলিম ইতিহাসের পুনর্জাগরণ ঘটিয়েছে। তাদের এই সাহসী পদক্ষেপ শুধু হজ পালন নয়, বরং ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক পুনরুদ্ধারের এক শক্ত বার্তা। মুসলিম বিশ্বে এ ধরনের সচেতনতা ও আত্মপরিচয়ের অভিযাত্রা আজকের দিনে যেমন প্রাসঙ্গিক, তেমনি প্রয়োজনীয়ও।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button