বানিজ্য

রাত পোহালেই বিজিএমইএর নির্বাচন, ৩৫ পদে ৩ প্যানেলের ৭৬ প্রার্থী

আগামীকাল শনিবার দেশের তৈরি পোশাকশিল্পের সবচেয়ে প্রভাবশালী সংগঠন বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিজিএমইএ)-এর পরিচালনা পর্ষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। ঢাকা ও চট্টগ্রামে একযোগে অনুষ্ঠিতব্য এই নির্বাচনে ৩৫টি পরিচালক পদে লড়ছেন তিনটি প্যানেলের মোট ৭৬ জন প্রার্থী। এবারের ভোটের দিকে তাকিয়ে রয়েছে তৈরি পোশাকশিল্পের উদ্যোক্তারা, কারণ একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন বর্তমান শিল্প পরিস্থিতিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।

নির্বাচনের আয়োজনে প্রস্তুতি চূড়ান্ত

নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে ঢাকার র‍্যাডিসন ব্লু ওয়াটার গার্ডেন হোটেল এবং চট্টগ্রামের র‍্যাডিসন ব্লু হোটেল বে ভিউ কেন্দ্রে সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত। নির্বাচনে মোট ভোটার ১,৮৬৪ জন। এর মধ্যে ঢাকায় ১,৫৬১ জন এবং চট্টগ্রামে ৩০৩ জন। আগেরবারের তুলনায় এবার ভোটার সংখ্যা কিছুটা কম হলেও, সচল কারখানার উদ্যোক্তারাই কেবল ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগ পেয়েছেন।

বিজিএমইএর প্রশাসক মো. আনোয়ার হোসেন জানিয়েছেন, একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিত করতে সব ধরনের প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হয়েছে। নির্বাচন পরিচালনায় বিজিএমইএর নিজস্ব কোনো কর্মকর্তা যুক্ত থাকছেন না। সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তারা দায়িত্ব পালন করবেন।

তিন প্যানেল, মূল লড়াই দুটি শিবিরে

নির্বাচনে তিনটি প্যানেল প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে—ফোরাম, সম্মিলিত পরিষদ ও ঐক্য পরিষদ। তবে মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে ফোরাম ও সম্মিলিত পরিষদের মধ্যে, কারণ এ দুটি প্যানেলই ঢাকা ও চট্টগ্রাম উভয় অঞ্চলেই পূর্ণাঙ্গ প্রার্থী দিয়েছে। ঐক্য পরিষদের প্রার্থী সংখ্যা মাত্র ছয়জন হওয়ায় তাদের প্রভাব সীমিত বলেই ধারণা করা হচ্ছে।

ফোরামের নেতৃত্বে রয়েছেন রাইজিং ফ্যাশনসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাহমুদ হাসান খান। তিনি এর আগে বিজিএমইএর সহসভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। অন্যদিকে সম্মিলিত পরিষদের দলনেতা চৈতি গ্রুপের এমডি মো. আবুল কালাম, যিনি এক দশক আগে বিজিএমইএর পরিচালক ছিলেন।

দুই প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বীর অবস্থান ও অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগ

ফোরামের দলনেতা মাহমুদ হাসান খান নির্বাচন ঘিরে আশাবাদী। তিনি বলেন, “প্রচার-প্রচারণা যথেষ্ট হয়েছে। আমরা আশা করছি, ভোটাররা যোগ্য নেতৃত্ব নির্বাচনে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করবেন। তবে আমরা উদ্বিগ্ন যে, সম্মিলিত পরিষদ ভোটকেন্দ্র ঘিরে বহিরাগতদের এনে শক্তি প্রদর্শনের চেষ্টা করছে। আমরা নির্বাচন বোর্ডে এ বিষয়ে লিখিত অভিযোগ দিয়েছি।”

সম্মিলিত পরিষদের দলনেতা আবুল কালাম অবশ্য এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, “এই অভিযোগের কোনো ভিত্তি নেই। আমাদের প্রত্যাশা, এবারের নির্বাচন অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় বেশি সুষ্ঠু হবে। আমরা জয়ের বিষয়ে শতভাগ আশাবাদী।”

পূর্ববর্তী বিতর্কিত নির্বাচন ও প্রশাসক নিয়োগের প্রেক্ষাপট

গত বছরের মার্চ মাসে অনুষ্ঠিত বিজিএমইএ নির্বাচনে সম্মিলিত পরিষদ সব পদে জয়ী হলেও, সেই নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হয়। নির্বাচিত সভাপতি এস এম মান্নানের বিরুদ্ধে একাধিক হত্যা মামলা এবং রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের কারণে তিনি কার্যত নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েন। এরপর সহসভাপতি খন্দকার রফিকুল ইসলামকে সভাপতির দায়িত্ব দেওয়া হলেও, সংগঠনের কার্যক্রমে স্থবিরতা দেখা দেয়। এ প্রেক্ষিতে গত বছরের ২০ অক্টোবর বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বিজিএমইএর পরিচালনা পর্ষদ বাতিল করে প্রশাসক নিয়োগ দেয়।

এই পরিস্থিতি থেকেই এবারের নির্বাচন নতুন নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সংগঠনটির কার্যক্রম পুনরুজ্জীবিত করার একটি বড় সুযোগ হিসেবে দেখা হচ্ছে।

প্রার্থীদের তালিকা ও অঞ্চলভিত্তিক অবস্থান

ফোরামের প্রার্থী তালিকা:

ঢাকা অঞ্চল: মাহমুদ হাসান খান, মোহাম্মদ আবদুস সালাম, কাজী মিজানুর রহমান, মো. শিহাব উদ্দোজা চৌধুরী, ইনামুল হক খান, মো. হাসিব উদ্দিন, মোহাম্মদ সোহেল, শেখ এইচ এম মোস্তাফিজ, ভিদিয়া অমৃত খান, এম এ রহিম, শাহ রাঈদ চৌধুরী, মিজানুর রহমান, জোয়াদ্দার মো. হোসনে কামার আলম, এ বি এম শামছুদ্দিন, নাফিস–উদ–দৌলা, সুমাইয়া ইসলাম, আনোয়ার হোসেন চৌধুরী, মজুমদার আরিফুর রহমান, মোজাম্মেল হক ভূঁইয়া, ফাহিমা আক্তার, আসেফ কামাল পাশা, রশীদ আহমেদ হোসাইনী, রুমানা রশীদ, সামিহা আজিম, রেজওয়ান সেলিম, ফয়সাল সামাদ।

চট্টগ্রাম অঞ্চল: সেলিম রহমান, মো. শরীফ উল্লাহ, মোহাম্মদ রফিক চৌধুরী, এম মহিউদ্দিন চৌধুরী, সাকিফ আহমেদ সালাম, এনামুল আজিজ চৌধুরী, এমদাদুল হক চৌধুরী, মির্জা মো. আকবর আলী চৌধুরী, রিয়াজ ওয়েজ।

সম্মিলিত পরিষদের প্রার্থী তালিকা:

ঢাকা অঞ্চল: মো. আবুল কালাম, আবদুল্লাহ হিল রাকিব, মির্জা ফায়েজ হোসেন, মো. নুরুল ইসলাম, তামান্না ফারুক থিমা, হেলাল উদ্দিন আহমেদ, মহিউদ্দিন রুবেল, খন্দকার রফিকুল ইসলাম, মো. শাহদাৎ হোসেন, মো. রেজাউল আলম, ফারুক হাসান, এ কে এম আজিমুল হাই, লিথি মুনতাহা মহিউদ্দিন, মো. আশিকুর রহমান, এস এম মনিরুজ্জামান, মো. মশিউল আজম, মোহাম্মদ রাশেদুর রহমান, আবরার হোসেন সায়েম, মোহাম্মদ সোহেল সাদাত, সয়েদ সাদিক আহমেদ, মোস্তাজিরুল শোভন ইসলাম, মঞ্জুরুল ফয়সাল হক, সাইফুদ্দিন সিদ্দিকী সাগর, মোহাম্মদ কামাল উদ্দীন, ফিরোজ আলম, আসিফ আশরাফ।

চট্টগ্রাম অঞ্চল: এস এম আবু তৈয়ব, রাকিবুল আলম চৌধুরী, মোহাম্মদ মুসা, অঞ্জন কুমার দাশ, নাফিদ নবি, সৈয়দ মোহাম্মদ তানভীর, মোস্তফা সারোয়ার রিয়াদ, মো. আবসার হোসেন, গাজী মো. শহীদ উল্লাহ।

ঐক্য পরিষদের প্রার্থী:
মোহাম্মদ মহসিন, দেলোয়ার হোসেন, খালেদ মো. ফয়সাল ইকবাল, এ কে এম আবু রায়হান, মো. মহসিন অপু, শেখ এরশাদ উদ্দিন।

ভবিষ্যৎ প্রত্যাশা ও গুরুত্ব

বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ রপ্তানি খাত তৈরি পোশাক শিল্প। এই খাতের নীতিনির্ধারক সংগঠন হিসেবে বিজিএমইএর নেতৃত্ব গুরুত্বপূর্ণ। একটি সুষ্ঠু ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনই পারবে বিজিএমইএর মর্যাদা ও কার্যকারিতা পুনরুদ্ধার করতে।

বিশ্লেষকদের মতে, নির্বাচনপরবর্তী নেতৃত্বের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হবে শিল্প খাতের সংকট মোকাবিলা, আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতা টিকিয়ে রাখা, এবং শ্রমিক-মালিক সম্পর্ক উন্নয়নের মতো গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুগুলো সমাধান করা।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button