বিশ্ব

গাজায় দুর্ভিক্ষের দ্বারপ্রান্তে শিশু ইসরায়েলি অবরোধে ক্ষুধায় কঙ্কালসার

ইসরায়েলি অবরোধে গাজার শিশুদের জীবন হুমকির মুখে। পাঁচ মাসের শিশু সিওয়ারের করুণ পরিণতির গল্প তুলে ধরেছে বিবিসি। ফর্মুলা দুধের অভাবে মারাত্মক অপুষ্টিতে ভুগছে সে।

যুদ্ধ, অবরোধ ও ক্ষুধার ভয়াবহ চিত্র: গাজার শিশু সিওয়ারের গল্প

ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলি সামরিক অবরোধ ও ধারাবাহিক হামলার ফলে দেখা দিয়েছে ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়। জাতিসংঘ ও বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা বারবার হুঁশিয়ারি দেওয়ার পরও অবরোধ কমেনি, বরং পরিস্থিতি দিন দিন আরও খারাপ হচ্ছে। সেই সংকটের হৃদয়বিদারক প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠেছে পাঁচ মাস বয়সী শিশু সিওয়ার আশুর, যার দুর্বল ও কঙ্কালসার শরীর বিশ্ব বিবেককে নাড়িয়ে দিয়েছে।

ক্ষুধা আর যন্ত্রণায় ঘেরা একটি শৈশব

সিওয়ার এখন তার মা নাজওয়া ও নানি রিমের সঙ্গে একটি অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্রে বসবাস করছে। গাজার খান ইউনিসের গুঁড়িয়ে যাওয়া একটি ঘরের পাশে ত্রিপল আর টিনের ছাউনি দিয়ে তৈরি করা হয়েছে এই আশ্রয়। সেখানেই ক্যামেরাবন্দি হয়েছে এক করুণ দৃশ্য—নাজওয়ার কোলে অপুষ্টিতে জর্জর শিশুটি নিঃশব্দে তাকিয়ে আছে শূন্য দৃষ্টিতে। তার দেহে মাছি উড়ছে, আর মা কাপড়ে ঢেকে দিচ্ছেন, যাতে পোকামাকড় কামড়াতে না পারে।

সিওয়ারের জন্ম হয়েছিল ২০২৪ সালের নভেম্বরে। তখন থেকেই তার জীবন কেটেছে যুদ্ধের ধ্বংসস্তূপের মধ্য দিয়ে। কোনো শান্তিপূর্ণ মুহূর্ত নেই তার জীবনে। কখনো ড্রোনের গর্জন, কখনো রকেট বিস্ফোরণ কিংবা ট্যাংকের আওয়াজ—এসবই তার চারপাশের নিত্যসঙ্গী।

অপুষ্টি আর ত্রাণঘাটির মরণফাঁদ

সিওয়ারের শরীর এখন মাত্র দুই কেজি ওজনের, অথচ পাঁচ মাস বয়সী শিশুর গড় ওজন হওয়া উচিত ছয় কেজি বা তার বেশি। তার এই মারাত্মক অপুষ্টির জন্য দায়ী ইসরায়েলের কঠোর অবরোধ, যা গাজায় প্রয়োজনীয় খাদ্য, ওষুধ ও শিশুখাদ্য প্রবেশে বাধা সৃষ্টি করছে। শিশু সিওয়ার প্রচণ্ড অ্যালার্জির কারণে সাধারণ ফর্মুলা দুধ সহ্য করতে পারে না। হাসপাতালের চিকিৎসকেরা বিশেষ এক ধরনের দুধ সরবরাহ করেছিলেন, কিন্তু সেটিও দ্রুত ফুরিয়ে গেছে।

সিওয়ারের মা নাজওয়া বলেন,

“হাসপাতালে থাকাকালীন ওর অবস্থা কিছুটা স্থিতিশীল ছিল। কিন্তু বাড়ি ফেরার পর ওজন কমতে শুরু করেছে। এখন অবস্থা আগের মতোই—হাড় জিরজিরে, দুর্বল।”

নাজওয়া নিজেও অপুষ্টিতে ভুগছেন। যুদ্ধ আর অবরোধের কারণে পরিবারের তিন প্রজন্ম—সিওয়ার, নাজওয়া এবং নানি রিম—একসঙ্গে খাদ্য সংকটে দিন পার করছেন। পরিষ্কার পানি, দুধ, এমনকি ডায়াপারও এখন তাদের নাগালের বাইরে।

ভয়, মৃত্যু আর মরদেহ ঘেরা জীবন

গাজায় অবস্থান করা বিবিসির স্থানীয় ক্যামেরাম্যান (নিরাপত্তার কারণে নাম প্রকাশ হয়নি) শিশুটির অবস্থা দেখে হৃদয়বিদারক বর্ণনা দিয়েছেন। তিনি বলেন,

“সিওয়ারের কান্না আর ক্ষীণ শরীর আমাকে ভিতর থেকে ভেঙে দিয়েছে।”

তিনি দেখেছেন কীভাবে শিশুদের দেহাংশ সাদা কাফনে মোড়ানো হয়, নাম থাকলে কাফনের ওপর লেখা হয়। তিনি নিজেই ওই নরকের ভেতরে বন্দি। প্রতিদিন তার চোখের সামনে অসংখ্য অনাহারী, মৃতপ্রায় মানুষ পড়ে থাকে, আর সেই দৃশ্য তাকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে তোলে।

বাস্তবতা মানতে নারাজ ইসরায়েল

ইসরায়েলি সামরিক প্রশাসন কোগাট সম্প্রতি দাবি করেছে, গাজায় খাদ্যসংকট নেই এবং শিশু খাদ্যসহ প্রয়োজনীয় দ্রব্য সরবরাহ করা হচ্ছে। তারা আরও অভিযোগ করেছে, হামাস ত্রাণ চুরি করে।

কিন্তু এই দাবি খারিজ করে দিয়েছে জাতিসংঘ, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্রসহ অনেক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা। তারা বলছে, গাজায় মারাত্মক খাদ্য ও চিকিৎসা সংকট চলছে এবং দুর্ভিক্ষ শুরুর আশঙ্কা প্রবল।

আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নীরবতা ও নাজওয়াদের সংগ্রাম

গাজায় প্রতিটি মা এখন সন্তানকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য দিনরাত যুদ্ধ করছেন। বুকের দুধ তৈরি করতে না পারা, শিশু খাদ্য না পাওয়া, কিংবা যুদ্ধের কারণে ঘরছাড়া হয়ে নিরাপত্তাহীনতায় থাকা—এই সবকিছু মিলিয়ে নারীরা চরম মানবিক বিপর্যয়ের মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন।

নাজওয়া বলেন,

“পরিস্থিতি ভয়াবহ। খাবার নেই, পানি নেই, আশ্রয়েরও ঠিক নেই। শিশুদের জন্য কিছু করতে না পারার বেদনা আমাকে তাড়িয়ে বেড়ায়।”

বিবেক কি জাগবে?

সিওয়ার একক কোনো কাহিনি নয়। গাজার হাজারো শিশুর প্রতিচ্ছবি সে। জাতিসংঘ ২০২৫ সালের মে মাসে জানিয়েছে, গাজায় মানবিক পরিস্থিতি “নিষ্ঠুরতম পর্যায়ে” পৌঁছেছে। অথচ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ভূমিকা এখনও প্রশ্নবিদ্ধ।

এই মুহূর্তে সবচেয়ে জরুরি হলো যুদ্ধবিরতি, অবরোধ প্রত্যাহার এবং টেকসই মানবিক সহায়তা নিশ্চিত করা। নয়তো সিওয়ারের মতো আরও কত শত শিশু হয়তো পৃথিবী থেকে বিদায় নেবে ক্ষুধার নির্মম থাবায়।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button