জাতীয়

ছয় শিশুশিক্ষার্থীকে ধর্ষণের মামলায় মাদ্রাসাশিক্ষকের আমৃত্যু কারাদণ্ড

চট্টগ্রাম নগরীর একটি মাদ্রাসায় ছয় শিশুশিক্ষার্থীকে বারবার ধর্ষণের অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত হওয়া মাদ্রাসাশিক্ষক নাজিমুদ্দীনকে আমৃত্যু কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। একইসঙ্গে তাঁকে ৫ লাখ টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়েছে। দীর্ঘ বিচারিক প্রক্রিয়া শেষে আজ বুধবার (৪ জুন) চট্টগ্রাম নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল–৭ এর বিচারক ফেরদৌস আরা এ রায় ঘোষণা করেন।

রায়ের সময় আসামি আদালতে উপস্থিত ছিলেন এবং রায় ঘোষণার পরপরই তাঁকে পুলিশ পাহারায় কারাগারে পাঠানো হয়। আদালতের এ রায়কে “দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি” হিসেবে দেখছেন অনেকেই, যারা শিশুদের ওপর যৌন সহিংসতার বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান চান।

অভিযুক্তের পরিচয় ও অপরাধের পটভূমি

দণ্ডিত নাজিমুদ্দীন (৪১) ফটিকছড়ির নাজিরহাট এলাকার বাসিন্দা গোলমুর রহমানের ছেলে। তিনি নগরীর একটি মাদ্রাসায় দীর্ঘদিন শিক্ষকতা করছিলেন। তার শিক্ষাদান পেশার আড়ালে চলে আসছিল শিশু শিক্ষার্থীদের ওপর নৃশংস যৌন নির্যাতন।

আদালত সূত্রে জানা যায়, ২০১৯ সালের ১৫ আগস্ট থেকে ২০২১ সালের ১ মার্চ পর্যন্ত সময়কালে তিনি একই মাদ্রাসার অন্তত ছয়জন শিশুশিক্ষার্থীকে একাধিকবার ধর্ষণ করেন। নির্যাতনের বিষয় গোপন রাখতে শিশুদের ভয় দেখানো হতো। এক পর্যায়ে একজন শিক্ষার্থী প্রতিবাদ করলে তাকে মারধর করা হয়, যার ফলে সে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ে। পরে তার পরিবারের সদস্যরা বিষয়টি জানতে পারেন।

মামলা ও তদন্ত প্রক্রিয়া

ভুক্তভোগী এক শিক্ষার্থীর বড় ভাই বাদী হয়ে ২০২১ সালের ৪ মার্চ চট্টগ্রাম নগরের পাঁচলাইশ থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা করেন। তদন্ত শেষে পুলিশ দোষী সাব্যস্ত করে অভিযোগপত্র দাখিল করে।

২০২১ সালের ৪ নভেম্বর আসামির বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিকভাবে অভিযোগ গঠন করা হয় এবং বিচারকাজ শুরু হয়। মামলায় ১১ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়, যার মধ্যে ছিলেন ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীরা, তাদের পরিবার ও মামলার তদন্ত কর্মকর্তারা।

রায়ে কী বললেন আদালত?

সরকারি কৌঁসুলি শফিউল মোরশেদ চৌধুরী জানান, বিচারক ফেরদৌস আরা রায়ে বলেন, “অভিযুক্ত ব্যক্তি ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক হিসেবে একটি অত্যন্ত সম্মানজনক অবস্থানে ছিলেন। অথচ তিনি সেই আস্থার অপব্যবহার করে নিষ্পাপ শিশুদের উপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চালিয়েছেন। এমন অপরাধ মানবতা বিরোধী এবং এর শাস্তি হতে হবে দৃষ্টান্তমূলক।”

আদালত আমৃত্যু কারাদণ্ডের পাশাপাশি ৫ লাখ টাকা অর্থদণ্ড আরোপ করেন। অর্থদণ্ড অনাদায়ে আরো এক বছরের কারাদণ্ডের আদেশও দিয়েছেন বিচারক।

মামলার গুরুত্ব ও সামাজিক প্রতিক্রিয়া

এই মামলার রায়কে শিশু অধিকার সংগঠনগুলো একটি যুগান্তকারী রায় হিসেবে দেখছে। অনেকেই বলছেন, এ রায়ের মাধ্যমে একটি বার্তা দেওয়া হলো—ধর্মীয়, সামাজিক বা প্রাতিষ্ঠানিক পরিচয় কোনো অপরাধীর রক্ষা কবচ হতে পারে না।

বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের (BSAF) চট্টগ্রাম শাখার সমন্বয়কারী সেলিনা পারভীন বলেন, “আমরা এমন শাস্তিই চেয়েছিলাম। দেশের প্রতিটি মাদ্রাসা, স্কুল ও কোচিং সেন্টারে এখন শিশুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এই রায় একটি ‘ওয়ার্নিং সিগনাল’ হিসেবে কাজ করবে।”

আইনজীবীদের প্রতিক্রিয়া

মামলার বাদীপক্ষের আইনজীবী বলেন, “শিশুদের উপর বারবার যে পাশবিকতা চালানো হয়েছে, সেটির বিচার পেতে আমাদের প্রায় সাড়ে তিন বছর লেগেছে। তবে রায়ে আমরা সন্তুষ্ট। আমরা চাই দ্রুততম সময়ের মধ্যে দেশের অন্যান্য শিশু নির্যাতনের মামলার বিচারও সম্পন্ন হোক।”

ভবিষ্যৎ করণীয় ও সরকারের ভূমিকা

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই রায় যদি কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন হয়, তাহলে তা সমাজে একটি শক্ত বার্তা দেবে। কিন্তু এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে প্রয়োজন বৃহৎ পরিসরে সচেতনতামূলক কার্যক্রম এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে কার্যকর নজরদারি ব্যবস্থা গড়ে তোলা।

আইনজীবী ও শিশু অধিকারকর্মীরা সরকারকে আহ্বান জানিয়েছেন—

  • মাদ্রাসাসহ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়মিত মনিটরিং কমিটি গঠন করতে।
  • শিশু নির্যাতন প্রতিরোধে স্কুল ও মাদ্রাসা পর্যায়ে সচেতনতামূলক কর্মশালা আয়োজন করতে।
  • শিশুদের মনোসামাজিক সাপোর্টের জন্য সাইকোলজিক্যাল কাউন্সেলিং ব্যবস্থা চালু করতে।

নাজিমুদ্দীনের আমৃত্যু কারাদণ্ড শুধু একজন অপরাধীর বিচার নয়, এটি দেশের শিশুদের নিরাপত্তা, মা-বাবার বিশ্বাস এবং সমাজের নৈতিক ভিত্তির প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমন রায় যেন ভবিষ্যতে কোনো শিক্ষক, অভিভাবক বা সমাজের উচ্চ অবস্থানের কেউ শিশুদের নিরাপত্তা লঙ্ঘনের আগে একবার হলেও চিন্তা করে।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button