বানিজ্য

সয়াবিন তেলের দাম বৃদ্ধি, নতুন দাম ১৮৯ টাকা

বাংলাদেশে খাদ্য উপকরণের বাজার স্থিতিশীলতা রক্ষায় ও ভোক্তার স্বার্থ সুরক্ষায় নীতিগত পদক্ষেপ হিসেবে সরকার ও শিল্পী সংস্থাগুলো সম্প্রতি এক বৃহত্তর সমন্বয়ের মধ্যে সয়াবিন তেলের নতুন দাম নির্ধারণ করেছে। এর ফলে এখন থেকে প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেলের বাজারমূল্য বেড়ে ১৭৫ টাকার পরিবর্তে দাঁড়াবে ১৮৯ টাকা—এবং খোলা সয়াবিন ও পাম তেলের ক্ষেত্রে লিটারপ্রতি ১৫৭ টাকার দাম বাড়িয়ে ১৬৯ টাকা করা হয়েছে। এই সিদ্ধান্তের পেছনে রয়েছে আমদানির ওপর আরোপিত ভ্যাটের হার পুনর্বিবেচনার সূচনা ও স্থানীয় উৎপাদন ও বিপণনে সহযোগিতা।

নবনির্ধারিত মূল্য ও তার প্রভাব

বোতলজাত সয়াবিন তেল

গবেষণা ও বাজার বিশ্লেষণের মাধ্যমে নিশ্চিত হওয়া গেছে, দেশের বাজারে সয়াবিন তেলের দাম লিটারপ্রতি ১৪ টাকা বেড়েছে। ফলে আগে ১৭৫ টাকায় বিক্রি হতো, এখন তা হয়ে উঠছে ১৮৯ টাকায়। এই পরিবর্তন শুধু ভোক্তার খরচ বাড়াবে না, বরং বাজারে সরবরাহকারী ও উৎপাদকদের অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতেও প্রভাব ফেলবে।

খোলা সয়াবিন ও পাম তেল

একইভাবে, খোলা সয়াবিন তেলের মূল্য ১৫৭ টাকা থেকে বেড়ে উঠছে ১৬৯ টাকায়। পাম তেলেও একই পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। অর্থাৎ, খোলা উভয় তেলের ক্ষেত্রে প্রতি লিটার ১২ টাকা করে বৃদ্ধি হয়েছে। এই মূল্য পরিবর্তনের ফলে খোলা তেল কিনতে আগ্রহী গ্রাহকেরা উচ্চ মূল্য প্রদানের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে, যা সামগ্রিক খাদ্যমূল্য ইনডেক্সে প্রভাব ফেলতে পারে।

বোতলজাত ৫ লিটার সয়াবিন তেল

আরও একটি উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হলো, বোতলজাত ৫ লিটার সয়াবিন তেলের দাম পরিবর্তিত হয়ে গেছে ৮৫২ টাকায় থেকে ৯২২ টাকায়। এই পরিবর্তন বাজারে বড় পরিসরে প্রভাব ফেলতে পারে, কারণ বহু পরিবার এবং বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান এখন এই তেলের ব্যবহার করে থাকে।

পরিবর্তনের পেছনের নীতিগত কারণ

ভ্যাটের হার পুনর্বিবেচনা

সরকার এবং খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সূত্রে জানা গেছে, ভোজ্যতেলের বাজারমূল্য স্থিতিশীল রাখতে পূর্বে আমদানিতে আরোপিত মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) ১৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছিল। এই মেয়াদ ৩১ মার্চ পর্যন্ত ছিল, এরপরই সাময়িকভাবে নতুন আদর্শে ভ্যাট আরোপ শুরু করা হয়েছে। নতুন নিয়ম অনুযায়ী, আমদানিতে ও স্থানীয় উৎপাদন পর্যায়ে আদর্শ হারে ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপিত হবে। তবে ভোক্তার স্বার্থের কথা বিবেচনায় ৮ শতাংশ হারে (বাড়িয়ে) মূল্য সমন্বয় করা হয়েছে, যার ফলে বোতলজাত সয়াবিন তেলের নতুন দাম দাঁড়িয়েছে ১৮৯ টাকা প্রতি লিটার

উৎপাদন ও আমদানির সমন্বয়

দেশে খাদ্য নিরাপত্তা ও বাজারের ভারসাম্য রক্ষায় জ্বালানি, কাঁচামাল ও উৎপাদন খাতে ভারসাম্য বজায় রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমানে, খাদ্য মন্ত্রণালয়ের নীতি অনুযায়ী আমদানির পাশাপাশি স্থানীয় উৎপাদন এবং বিপণনের খাতে সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। এই নতুন নীতিতে ভ্যাটের হার কমিয়ে দিতে এবং সেই সাথে পর্যাপ্ত আর্থিক সহায়তা নিশ্চিত করতে প্রশাসন উদ্যোগী হয়েছে।

বাজারে বৈষম্য ও প্রতিযোগিতা

বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন এবং অন্যান্য বাজার বিশ্লেষকরা অভিযোগ জানিয়েছেন যে, গ্যাস ও অন্যান্য উপকরণ যেমন, সয়াবিন ও পাম তেলের দাম নির্ধারণের প্রক্রিয়ায় বৈষম্য তৈরি হচ্ছে। পুরোনো প্রতিষ্ঠানে যারা বাজারে ইতিমধ্যে প্রবেশ করেছে, তাদের জন্য দাম তুলনামূলক কম থাকছে, আর নতুন প্রতিষ্ঠানকে বেশি মূল্য দিতে হচ্ছে। এই বৈষম্য নতুন বিনিয়োগকারীদের প্রতিযোগিতামূলক অবস্থায় পড়ে যাচ্ছে, যার ফলে বাজারে নতুন বিনিয়োগ নিয়ন্ত্রণে বাধা সৃষ্টি হতে পারে।

শিল্প ও ব্যবসায়ীদের প্রতিক্রিয়া

ব্যবসায়ীদের দৃষ্টিভঙ্গি

বাংলাদেশের বিভিন্ন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ও খাদ্য ব্যবসায়ী বলেছেন, “আমাদের উৎপাদন খাতে দীর্ঘদিন ধরে ভ্যাট ও আমদানির খরচ অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে রাখা হয়েছিল। এই নতুন নীতিতে মূল্য বাড়ানো হলে বিনিয়োগকারীদের জন্য খরচ বেড়ে যাবে এবং বাজারে প্রতিযোগিতার মাপকাঠি অসম হয়ে উঠবে।”

বাণিজ্য উপদেষ্টা বলেন, “নতুন দাম শুধু উৎপাদনেই নয়, সরবরাহ ও বিপণনের খাতে একটি বড় অগ্রগতি ঘটবে। তবে এর সাথে সাথে নতুন বিনিয়োগকারীদের জন্য প্রতিযোগিতার পরিবেশ অনেকটা কঠিন হয়ে পড়তে পারে।”

ভোক্তা ও সাধারণ মানুষের প্রতিক্রিয়া

সাধারণ গ্রাহকদের দৃষ্টিতে, তেলের দাম বাড়ার ফলে দৈনন্দিন জীবনে আর্থিক বোঝা বেড়ে যাবে। অনেক পরিবার ইতিমধ্যে দারিদ্র্য ও ব্যয় বৃদ্ধির সমস্যায় ভূগছেন। খাদ্য মন্ত্রনালয়ের সূত্রে জানা গেছে, এই পরিবর্তন আগামী ১৩ এপ্রিল থেকে কার্যকর হবে, যার ফলে বাজারে আগামী কিছু সপ্তাহের মধ্যে তেলের দাম স্থিতিশীল করার জন্য গ্রাহকদের সামনে নতুন চ্যালেঞ্জ আসতে পারে।

বিনিয়োগকারীদের উদ্বেগ

বিশ্লেষকরা বলছেন, বিনিয়োগের ক্ষেত্রে নতুন নীতির কারণে বাজারের প্রতিযোগিতা নতুন ধরনের চ্যালেঞ্জ তৈরি করবে। বর্তমানে দেশীয় ও বিদেশি বিনিয়োগকারীদের মধ্যে একটি দ্বিধা সৃষ্টি হয়েছে, যা দীর্ঘমেয়াদে শিল্প খাতে বিনিয়োগ কমে যেতে পারে এবং ফলস্বরূপ কর্মসংস্থান ও অর্থনৈতিক বৃদ্ধিতে অবনতি ঘটতে পারে।

বিদেশি বিনিয়োগ ও অর্থনৈতিক অবস্থা

ব্যাংকঋণ ও মূলধন বিনিয়োগে প্রভাব

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বেসরকারি খাতে ব্যাংকঋণের প্রবৃদ্ধি গত ১০ বছরের মধ্যে ন্যূনতম পর্যায়ে রয়েছে, যা অর্থনীতিতে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে একটি প্রাথমিক সংকেত। পাশাপাশি, মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি কমে যাওয়ার পরিসংখ্যানও নির্দেশ করে যে, খাতের বিনিয়োগে মনোযোগ কমে গেছে।

এইসব পরিবর্তনের মধ্যে গ্যাসের দাম বৃদ্ধি অন্তর্ভুক্ত হলে, শিল্প ও উৎপাদন সংস্থাগুলো নতুন বিনিয়োগ নিতে দ্বিধা করতে পারেন, যেটি দেশের মোট বিনিয়োগ হার কমিয়ে দিতে পারে। বর্তমানে, বিদেশি বিনিয়োগের হার গত অর্থবছরে ৭৪ কোটি ৪০ লাখ ডলারের তুলনায় কমে হয়েছে এবং এতে প্রত্যক্ষ প্রভাব ফেলছে শিল্পের বৃদ্ধির গতিতে।

অর্থনীতি ও বাজারে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব

বিশ্লেষকরা মত, যদি শিল্পে নতুন বিনিয়োগের ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা অসম হয়ে যায়, তবে বেসরকারি বিনিয়োগ কমে যেতে পারে, যার ফলে মানুষের আয় ও কর্মসংস্থান উভয় ক্ষেত্রেই নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। খাদ্য ও রফতানি খাতে তেলের দাম বৃদ্ধি সরাসরি মূল্যস্ফীতি বাড়াতে পারে, যা সাধারণ জনগণের জীবনযাত্রায় বোঝাপোড়া সৃষ্টি করতে পারে।

সরকারের ভূমিকা ও ভবিষ্যৎ পদক্ষেপ

নীতিগত পুনর্বিবেচনার আহ্বান

সাম্প্রতিক পরিবর্তিত ভ্যাট নীতির পরে, খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনও নতুন ঘোষণাপত্র বের করেছে। এতে বলা হয়েছে, ১৩ এপ্রিল থেকে কার্যকর হবে নতুন মূল্য। তবে সমিতির পক্ষ থেকে প্রকাশ্যে দাবি উঠেছে, “সরকার যদি প্রয়োজনমতো বিনিয়োগ ও উৎপাদনের পথে সহায়তা প্রদান না করে, তাহলে এর ফল স্বয়ং গ্রাহকদের ওপর পড়বে।”

শিল্প খাতে সহযোগিতা ও সমন্বয়

সরকার এই পরিবর্তনের পাশাপাশি প্রচেষ্টা চালাচ্ছে যাতে শিল্পখাতে গ্যাস, বিদ্যুৎ ও অন্যান্য উপকরণ যথাযথভাবে সরবরাহ করা যায়। সরকারের নীতি হল, শুধুমাত্র আমদানি কিংবা উৎপাদনে ভ্যাটের উপর নির্ভর না করে, বাজারে প্রতিযোগিতামূলক ও বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ তৈরি করা। তবে এ ক্ষেত্রে শিল্প ও বাণিজ্য সমিতির মধ্যে জাতীয় সমন্বয় সাধনের দিকে আরও মনোযোগ দিতে হবে।

বাংলাদেশে খাদ্য ও শিল্প খাতে গ্যাসের দাম বৃদ্ধি একটি সংবেদনশীল ও বহুমাত্রিক সমস্যা। এর ফলে নতুন বিনিয়োগকারীরা পুরোনো প্রতিযোগীদের সাথে প্রতিযোগিতায় পড়তে পারেন, যা দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং কর্মসংস্থান উপর গুরুতর প্রভাব ফেলতে পারে।

অর্থনীতি, বেসরকারি বিনিয়োগ, ব্যাংকঋণ, উৎপাদন খাতে মূল্যস্ফীতি এবং প্রযুক্তিগত অপচয়ের সঙ্গে এই নীতিগত পরিবর্তনের ফলাফল দীর্ঘমেয়াদে দেশের মানুষের জীবনযাত্রা ও আর্থিক স্থিতিশীলতার ওপর ব্যাপক চাপ সৃষ্টি করবে। সরকার যদি সঠিক নীতিগত সমন্বয় ও শিল্পের সহযোগিতা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়, তবে ‘‘স্মার্ট বাংলাদেশ’’ গঠনের স্বপ্ন বাস্তবে পরিণত হওয়া কঠিন হয়ে পড়বে।

এই পরিস্থিতিতে, শিল্পের নেতা, বিনিয়োগকারীরা ও সাধারণ জনগণের সম্মিলিত অংশগ্রহণে প্রয়োজন নীতি সংস্কার ও সহযোগিতামূলক পদক্ষেপ গ্রহণের, যাতে করে সমাজের সব স্তরের মানুষের জন্য একটি স্থিতিশীল এবং উন্নয়নশীল পরিবেশ নিশ্চিত করা যায়।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button