আত্মঘাতী ড্রোন তৈরিতে রুশ কারখানায় আফ্রিকান তরুণীদের নিযুক্তি

রাশিয়ার তাতারস্তান অঞ্চলের আলাবুগা বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে ইরানি প্রযুক্তিনির্ভর আত্মঘাতী ড্রোন উৎপাদন করছে একটি গোপন কারখানা। এই ড্রোন তৈরির কাজে নিযুক্ত করা হচ্ছে শত শত আফ্রিকান তরুণীকে—এদের মধ্যে কেউ কেউ মাত্র ১৮ বছরেরও কম বয়সী। বিভিন্ন প্রতিশ্রুতি ও শিক্ষানামার ফাঁদে ফেলে তাদের নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে বলে আন্তর্জাতিক মহলে উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে, এই কর্মসূচি কি শুধুই শিক্ষানির্ভর, নাকি এর আড়ালে ঘটছে মানব পাচার ও যুদ্ধের কাজে জোরপূর্বক শ্রম ব্যবহার?
আলাবুগায় ড্রোন উৎপাদন ও সামরিক গুরুত্ব
২০২২ সালে রাশিয়া ইউক্রেনে হামলা চালানোর পর থেকেই আলাবুগায় ড্রোন তৈরির কার্যক্রম শুরু হয়। এই কারখানায় ইরানের তৈরি শাহেদ ড্রোনের প্রযুক্তির ভিত্তিতে ‘কামিকাজে’ বা আত্মঘাতী ড্রোন তৈরি হচ্ছে, যা ইউক্রেন যুদ্ধে ব্যবহার করা হচ্ছে।
২৩ এপ্রিল ২০২৫ তারিখে ইউক্রেনীয় ড্রোন এই কারখানায় হামলা চালায়। যদিও হতাহতের ঘটনা ঘটেনি, তবে ২০২৪ সালে এমনই এক হামলায় কয়েকজন আফ্রিকান নারী কর্মী আহত হয়েছিলেন, যাদের ডরমিটরি লক্ষ্যবস্তু হয়েছিল। এ থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়—এই কেন্দ্রটি ইউক্রেনীয় বাহিনীর জন্য একটি বৈধ সামরিক লক্ষ্য।
বিদেশি শিক্ষার আড়ালে শ্রমিক নিয়োগ
আলাবুগা কর্তৃপক্ষ দাবি করে, এটি মূলত একটি ‘ওয়ার্ক অ্যান্ড স্টাডি’ প্রোগ্রাম। ‘আলাবুগা স্টার্ট’ নামে পরিচালিত এই প্ল্যাটফর্মটি আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদেরকে রাশিয়ায় পড়াশোনা ও কাজের সুযোগের নামে আকৃষ্ট করে। এতে মূলত ক্যাটারিং, আতিথেয়তা বা প্রযুক্তিশিক্ষার কথা বলা হলেও বাস্তবে অধিকাংশ নিয়োগ হচ্ছে ড্রোন তৈরির কারখানায়।
অলাভজনক সংস্থা গ্লোবাল ইনিশিয়েটিভ অ্যাগেইনস্ট ট্রান্সন্যাশনাল অর্গানাইজড ক্রাইম-এর মতে, প্রকৃতপক্ষে এই প্রোগ্রামে যুক্ত প্রায় সব বিদেশি কর্মী ড্রোন তৈরির সঙ্গে সরাসরি জড়িত। অধিকাংশ ক্ষেত্রে নিযুক্ত নারীরা বয়সে তরুণ এবং তাদের নিয়ন্ত্রণ করা সহজ বলেই এমন পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।
আলাবুগা প্রধান তিমুর শাগিভালেভ এক বিবৃতিতে বলেন, ‘আফ্রিকান পুরুষেরা অনেক সময় আক্রমণাত্মক আচরণ করেন, তাই আমরা নারীদেরকেই বেশি প্রাধান্য দিচ্ছি।’ এই বক্তব্য থেকেই প্রকল্পটির পেছনে বিদ্যমান মনোভাবের একটি সুস্পষ্ট আভাস পাওয়া যায়।
কাজের ধরন জানেই না অনেক কর্মী
অনেক আফ্রিকান তরুণী জানেনই না যে, তারা কিসে কাজ করতে যাচ্ছেন। কেননা তাদের বাইরের কারও সঙ্গে কাজের তথ্য ভাগ করার অনুমতি নেই। এক ইথিওপিয়ান তরুণী জানান, ‘আমি এই কোম্পানির শ্রম পরিবেশ সম্পর্কে অনলাইনে খোঁজ নিয়ে আবেদন প্রত্যাহার করে নিই। আমি নিশ্চিত, অধিকাংশ মেয়ে জানেই না তারা কী কাজে নিযুক্ত হতে যাচ্ছে।’
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া আকর্ষণীয় ভিডিও ও টেলিগ্রামে চলা প্রচারণা এই কর্মসূচিকে আরও বিশ্বাসযোগ্য করে তোলে। তবে জাতিসংঘের মানবাধিকার পর্যবেক্ষকরা বলছেন, এতটাই প্রতারণামূলক পদ্ধতিতে এই নিয়োগ চলছে যে, পুরো প্রকল্পটিকে মানব পাচার হিসেবেও বিবেচনা করা যেতে পারে।
আফ্রিকার সরকারগুলো কী করছে?
এই ঘটনাগুলো শুধু মানবাধিকারের দৃষ্টিকোণ থেকে নয়, বরং কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক দিক থেকেও গুরুত্বপূর্ণ। কেন আফ্রিকার অসংখ্য তরুণ-তরুণী রাশিয়ার ড্রোন কারখানায় কাজ করছেন, সে প্রশ্ন এখন তীব্র হচ্ছে।
বিভিন্ন প্রতিবেদনে জানা যায়, আফ্রিকার কিছু দেশ যেমন কেনিয়া, উগান্ডা, বুরকিনা ফাসো—তারা আলাবুগা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক সমঝোতা স্বাক্ষর করেছে। এমনকি আলাবুগার ‘স্টার্ট’ প্রোগ্রামের বিজ্ঞাপন আফ্রিকার সরকারি গণমাধ্যমেও প্রচার করা হয়েছে। কেনিয়ার রুশ দূতাবাস দাবি করে, কেনিয়া সরকার এই কর্মসূচিকে তরুণদের জন্য লাভজনক বলেই মনে করছে।
তবে কেনিয়ার শ্রম মন্ত্রণালয়ের দাবি, মাত্র ১২ জন কেনিয়ান এই কর্মসূচিতে যোগ দিয়েছেন এবং তাদের কেউই ড্রোন কারখানায় নিযুক্ত নন। কিন্তু বাস্তবতা পুরোপুরি ভিন্ন। এখন পর্যন্ত শুধু বুরকিনা ফাসো একমাত্র দেশ যারা এই ধরনের নিয়োগ বন্ধের বিষয়ে কার্যকর উদ্যোগ নিয়েছে।
বেকারত্ব ও বিভ্রান্তিকর সমর্থন
আফ্রিকার বহু দেশের যুবক-যুবতী চরম বেকারত্বের মুখে পড়েছে। যুদ্ধ, দারিদ্র্য, দুর্নীতি ও দুর্বল শিক্ষাব্যবস্থার কারণে তারা যেকোনো কাজের জন্য প্রস্তুত। এই প্রেক্ষাপটে রাশিয়ার প্রস্তাবিত কর্মসূচিগুলো তাদের কাছে স্বপ্নের মতো মনে হয়।
আবার কেউ কেউ রাশিয়ার ইউক্রেনবিরোধী অবস্থানকেও সমর্থন করে। ফলে তারা সশরীরে রুশ কারখানায় কাজ করাকেও রাজনৈতিক সমর্থনের অংশ বলে মনে করে।
তবে ইউক্রেনের একজন কূটনীতিক বলেন, ‘এই প্রবণতা এক ভয়ংকর বাস্তবতা তৈরি করছে। কারণ, একসময় হয়তো একজন আফ্রিকান তরুণী ইউক্রেনীয় ক্ষেপণাস্ত্রের বৈধ লক্ষ্য হয়ে উঠবেন।’
মানবাধিকারের প্রশ্ন ও আন্তর্জাতিক উদ্বেগ
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো এই পরিস্থিতিকে অত্যন্ত উদ্বেগজনক বলে অভিহিত করছে। যুদ্ধবিধ্বস্ত অঞ্চলে প্রতারণার মাধ্যমে বিদেশি শ্রমিক ব্যবহার করা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার চুক্তির স্পষ্ট লঙ্ঘন। জাতিসংঘসহ ইউরোপীয় ইউনিয়ন এ বিষয়ে তদন্ত শুরু করেছে।
ইউক্রেন এরইমধ্যে আফ্রিকার বিভিন্ন সরকারকে চাপ দিচ্ছে যাতে এসব প্রতারণামূলক নিয়োগ বন্ধ করা হয়। তবে অনেক দেশই রাশিয়ার সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক নষ্ট করতে নারাজ হওয়ায় দৃঢ় অবস্থান নিচ্ছে না।
আলাবুগা ড্রোন কারখানায় আফ্রিকান তরুণীদের নিযুক্তির বিষয়টি এখন শুধু একটি মানবিক ইস্যু নয়, এটি বৈশ্বিক নিরাপত্তা ও মানবাধিকারের প্রশ্নও। শিক্ষার আড়ালে শ্রম ও সামরিক শিল্পে তরুণীদের ব্যবহার করা হচ্ছে প্রতারণার মাধ্যমে—এমন অভিযোগ দিন দিন বেড়েই চলেছে।
তবে সবচেয়ে বড় উদ্বেগের বিষয় হলো—এক সময় হয়তো এই তরুণীরাই ইউক্রেন যুদ্ধের বলির পাঁঠা হয়ে উঠবেন, যা আমাদের বিবেককে নাড়া দেওয়ার জন্য যথেষ্ট।