ট্রান্সজেন্ডারদের পাসপোর্ট বন্ধে ট্রাম্পের আদেশ অসাংবিধানিক: যুক্তরাষ্ট্রের আদালতের রায়

যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের একটি নির্বাহী আদেশ, যার মাধ্যমে ট্রান্সজেন্ডার ও নন-বাইনারি মার্কিন নাগরিকদের পাসপোর্ট দেওয়া বন্ধের চেষ্টা করা হয়, সেটিকে অসাংবিধানিক ঘোষণা করেছেন মার্কিন আদালত। বোস্টনের এক ফেডারেল বিচারক এই আদেশ দেন, যেটি ট্রান্সজেন্ডারদের অধিকার রক্ষায় একটি বড় ধরনের বিজয় বলে বিবেচিত হচ্ছে।
বিচারকের পর্যবেক্ষণ: ‘সংবিধান লঙ্ঘন, বিদ্বেষপ্রসূত নীতি’
বোস্টনের জেলা আদালতের বিচারক জুলিয়া কোবিক গতকাল শুক্রবার দেওয়া আদেশে বলেন, এই নির্বাহী আদেশ ও পররাষ্ট্র দপ্তরের সংশ্লিষ্ট নীতিমালা যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী লঙ্ঘন করে, যেখানে সকল নাগরিকের জন্য ‘সমান সুরক্ষা’র নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে।
বিচারক আরও বলেন, এই নীতিমালাটি স্পষ্টভাবে লিঙ্গ পরিচয়ের ভিত্তিতে বৈষম্য তৈরি করে এবং ট্রান্সজেন্ডারদের প্রতি ‘বিদ্বেষ’ থেকে উৎসারিত। তাঁর মতে, রাষ্ট্র পরিচালনায় ব্যক্তিগত বিশ্বাস বা পক্ষপাতিত্বের কোনো স্থান থাকা উচিত নয়, বিশেষ করে এমন একটি ক্ষেত্রে যেখানে নাগরিকদের মৌলিক অধিকার ক্ষুণ্ন হয়।
নীতির বিরুদ্ধে মামলা করেন সাত ট্রান্সজেন্ডার ব্যক্তি
এই আইনি লড়াই শুরু হয় সাতজন ট্রান্সজেন্ডার নাগরিকের যৌথ মামলার মাধ্যমে, যাঁরা যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের নতুন পাসপোর্ট নীতিমালাকে চ্যালেঞ্জ জানান। বিচারক কোবিক তাঁদের মধ্যে ছয়জনের পক্ষে আদেশ দিয়ে বলেছেন, এই নীতি তাঁদের ক্ষেত্রে কার্যকর হবে না এবং পররাষ্ট্র দপ্তরকে তাঁদের নির্ধারিত লিঙ্গ পরিচয়সহ পাসপোর্ট ইস্যু করতে হবে।
এখনই পুরো দেশে নিষেধাজ্ঞা নয়
তবে আদালত এই আদেশের প্রয়োগ শুধু মামলার বাদীদের ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ রেখেছেন। বিচারকের মতে, মামলার পক্ষ সমগ্র দেশের জন্য নীতিটির ওপর নিষেধাজ্ঞা চাওয়ার যৌক্তিকতা যথাযথভাবে তুলে ধরতে পারেননি। তবে ভবিষ্যতে মামলাটি পুরোপুরি নিষ্পত্তি হলে ব্যাপক পরিসরে এর প্রভাব পড়তে পারে।
কী বলছেন মানবাধিকার সংগঠনগুলো?
মামলার বাদীদের পক্ষে কাজ করা মানবাধিকার সংগঠন আমেরিকান সিভিল লিবার্টিজ ইউনিয়নের (ACLU) আইনজীবী লি নৌলিন-সোল এক বিবৃতিতে বলেন, “এই নীতি বিভ্রান্তিকর এবং অসাংবিধানিক। আমরা নিশ্চিত করব, এমন সব ব্যক্তির ক্ষেত্রেও আদালতের এই রায়ের সুরক্ষা পৌঁছে যায়, যারা তাঁদের সত্তা অনুযায়ী বাঁচতে চান।”
তিনি আরও বলেন, “সব নাগরিকের জন্য সমান সুযোগ ও মর্যাদাপূর্ণ জীবনযাপনের অধিকার নিশ্চিত করা যুক্তরাষ্ট্রের সাংবিধানিক দায়িত্ব।”
কী ছিল ট্রাম্পের নির্বাহী আদেশে?
সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সময়কালে পররাষ্ট্র দপ্তর নতুন নীতিমালা চালু করে, যাতে বলা হয়, কেবলমাত্র জন্মসনদ বা চিকিৎসা সংক্রান্ত দাপ্তরিক প্রমাণ অনুযায়ী লিঙ্গ পরিচয় পাসপোর্টে উল্লেখ করা যাবে। এর মানে হচ্ছে, কোনো ট্রান্সজেন্ডার ব্যক্তি তাঁর বর্তমান লিঙ্গ পরিচয় অনুযায়ী পাসপোর্ট পেতে পারবেন না, যদি না তার ‘জৈবিক লিঙ্গ’ অনুযায়ী উপযুক্ত প্রমাণ থাকে।
এই নীতির কারণে অনেক ট্রান্সজেন্ডার ও নন-বাইনারি নাগরিক কার্যত সরকারি পরিচয়পত্র থেকে বঞ্চিত হন, যা তাঁদের চাকরি, ভ্রমণ ও অন্যান্য সামাজিক সেবার ক্ষেত্রে বড় প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়।
পররাষ্ট্র দপ্তরের নীরবতা
এই বিষয়ে মন্তব্য চাইলে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর ও হোয়াইট হাউস কোনো প্রতিক্রিয়া জানায়নি। তবে আদালতের আদেশে পররাষ্ট্র দপ্তরকে তাঁদের নীতিমালায় পরিবর্তন আনার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, যাতে পাসপোর্ট ইস্যুর ক্ষেত্রে ব্যক্তির সত্তার প্রতি সম্মান দেখানো হয়।
ট্রান্সজেন্ডারদের জন্য কেন এটি গুরুত্বপূর্ণ?
একজন ট্রান্সজেন্ডার নাগরিকের জন্য পাসপোর্টে সঠিক লিঙ্গ পরিচয় থাকা কেবল একটি আইনি বা প্রাতিষ্ঠানিক বিষয় নয়, এটি তাঁর ব্যক্তিত্ব ও মর্যাদার স্বীকৃতিও। ভুল লিঙ্গ পরিচয় উল্লেখ করা পাসপোর্ট তাদের নিরাপত্তা, আত্মপরিচয় ও সামাজিক মিথস্ক্রিয়ায় প্রতিবন্ধকতা তৈরি করতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রে বর্তমানে লাখো ট্রান্সজেন্ডার নাগরিক রয়েছেন, যাঁরা বহুদিন ধরেই সমানাধিকার ও স্বীকৃতির দাবিতে আন্দোলন করে যাচ্ছেন। এই রায় তাঁদের সংগ্রামে একটি বড় অগ্রগতি হিসেবেই দেখা হচ্ছে।
ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশনা
বিচারক জুলিয়া কোবিকের এই প্রাথমিক আদেশ ভবিষ্যতে পূর্ণাঙ্গ রায়ের ভিত্তি হিসেবে কাজ করতে পারে। যদি আদালত পরে এই নীতিমালাকে সম্পূর্ণরূপে বাতিল করেন, তাহলে ট্রাম্পের সময়কার অনেক বিতর্কিত নীতির একটি চূড়ান্ত পরাজয় হিসেবে বিবেচিত হবে।
এদিকে, ট্রাম্প প্রশাসনের সময় আরো কিছু নীতিমালা গৃহীত হয়েছিল যেগুলো এলজিবিটিকিউ+ সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে বৈষম্যমূলক ছিল—যেমন, ট্রান্সজেন্ডার সেনা সদস্যদের নিষিদ্ধ করা, স্বাস্থ্যসেবায় পরিচয় সংকটে ফেলা ইত্যাদি। এসব নিয়েও বর্তমানে একাধিক মামলা চলমান রয়েছে।
এই রায় যুক্তরাষ্ট্রের ট্রান্সজেন্ডার ও নন-বাইনারি জনগোষ্ঠীর জন্য শুধু একটি আইনি জয় নয়, বরং সম্মান, মর্যাদা ও আত্মপরিচয়ের সংগ্রামে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। তবে পুরো দেশে এই নীতি নিষিদ্ধ না হওয়া পর্যন্ত লড়াই চলবে বলেই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।