শুল্ক ঝুঁকিতে এক হাজার পোশাক কারখানা, মাসে বাড়তি খরচ ২৫০ মিলিয়ন ডলার

বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্প বর্তমানে ইতিহাসের অন্যতম চ্যালেঞ্জিং সময় পার করছে। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ৩৭ শতাংশ শুল্ক পুরোপুরি প্রত্যাহার না হলে, দেশের প্রধান রপ্তানি খাতকে প্রতি মাসে গড়ে ২৫০ মিলিয়ন ডলার অতিরিক্ত শুল্ক দিতে হতে পারে। এই আর্থিক চাপ দেশের প্রায় এক হাজার পোশাক কারখানার টিকে থাকা প্রশ্নের মুখে ফেলতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন তৈরি পোশাক খাত সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী নেতারা।
সম্প্রতি রাজধানীর উত্তরা এলাকায় জায়ান্ট বিজনেস টাওয়ারে বিজিএমইএ নির্বাচন ২০২৫-২০২৭ উপলক্ষে আয়োজিত সম্মিলিত পরিষদের নির্বাচনী অফিস উদ্বোধন এবং দোয়া মাহফিলে এই উদ্বেগ প্রকাশ করেন পোশাকশিল্পের নেতারা। অনুষ্ঠানে বক্তারা বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি শতকরা ৩৭ ভাগ শুল্কের মুখে পড়েছে, যা সাময়িকভাবে ৯০ দিনের জন্য স্থগিত করা হয়েছে। যদিও এই সিদ্ধান্ত প্রশংসনীয়, তবে শুল্ক পুরোপুরি প্রত্যাহার না হলে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকশিল্প টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে পড়বে।
সম্মিলিত পরিষদের প্যানেল লিডার মো. আবুল কালাম বলেন, ‘আমাদের রপ্তানি প্রবৃদ্ধির এই সংকটময় সময়ে মার্কিন বাজারে ৩৭ শতাংশ শুল্কের ৯০ দিনের স্থগিতাদেশ নিঃসন্দেহে স্বস্তির খবর। এজন্য অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে ধন্যবাদ জানাই। তবে এ সমস্যা সমাধানের জন্য কূটনৈতিক পর্যায়ে দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ জরুরি।’
তিনি আরও বলেন, ‘৯০ দিনের এই সময়সীমা শেষে যেন আমাদের পণ্যের ওপর আবারও শুল্ক আরোপ না হয়, সে লক্ষ্যে কূটনৈতিক তৎপরতা অব্যাহত রাখতে হবে। প্রয়োজনে প্রধান উপদেষ্টাকে সরাসরি যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসনের সঙ্গে আলোচনায় বসার আহ্বান জানাই।’
বাংলাদেশ তৈরি পোশাকশিল্প বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম রপ্তানি খাত। দেশের মোট রপ্তানি আয়ের প্রায় ৮৫ শতাংশ আসে এ খাত থেকে। তবে বর্তমানে এই খাত শুল্ক কাঠামোর বৈষম্যের কারণে বড় ধরনের সংকটে পড়ার আশঙ্কায় রয়েছে। শুল্ক বহুলাংশে আমদানিকারকের দায়িত্ব হলেও, বাস্তবে অধিকাংশ ক্রেতা এই শুল্কভার সরাসরি রপ্তানিকারকের কাঁধেই চাপিয়ে দিচ্ছেন বলে জানান ব্যবসায়ীরা।
এ প্রসঙ্গে বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি ও সম্মিলিত পরিষদের প্রধান সমন্বয়কারী ফারুক হাসান বলেন, ‘বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাত যে সাফল্যের ধারা বজায় রেখে এগিয়ে যাচ্ছে, তার পেছনে সম্মিলিত পরিষদের অবদান অনস্বীকার্য। কিন্তু আন্তর্জাতিক বাণিজ্য পরিস্থিতির এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সরকারের পাশাপাশি ব্যবসায়ীদেরও ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা প্রয়োজন।’
ফারুক হাসান আরও বলেন, ‘আমরা যদি যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে এই শুল্ক সমস্যার সমাধান না করি, তাহলে এ খাতের জন্য ভবিষ্যৎ ভয়াবহ হবে। যুক্তরাষ্ট্র একতরফাভাবে এই শুল্ক আরোপ করেছে নিজেদের বাণিজ্য ঘাটতি কমানোর কৌশলের অংশ হিসেবে। তবে এটি আমাদের অর্থনীতির জন্য বিরাট হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।’
তিনি আরও যুক্ত করেন, ‘আমরা এলডিসি (স্বল্পোন্নত দেশ) থেকে উত্তরণের প্রক্রিয়ায় আছি। এই উত্তরণ স্থগিত রেখে সময়সীমা অন্তত তিন বছর বাড়ানোর দাবি জানাচ্ছি, কারণ এখনই এই উত্তরণ আমাদের ব্যবসায়িক পরিবেশকে আরও দুর্বল করে তুলবে।’
এ সময় পোশাক শিল্প সংশ্লিষ্ট আরও অনেক নেতা-নেত্রী এই বিষয়ে বক্তব্য রাখেন। বিএনপি নেতা জয়নাল আবেদীন ফারুক এই পরিস্থিতিতে সরকারের দায়িত্বশীল ভূমিকায় আশাবাদ প্রকাশ করেন এবং তৈরি পোশাক খাতের সংকট নিরসনে জাতীয় ঐকমত্য গঠনের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন।
বাংলাদেশ গার্মেন্টস বায়িং হাউজ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোফাজ্জল হোসেন পাভেল বলেন, ‘আন্তর্জাতিক ক্রেতারা যখন আমাদের শুল্কভার চাপিয়ে দিচ্ছে, তখন আমাদের পক্ষে এই খরচ বহন করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ছে। এমনিতেই পোশাক খাতে লাভের হার অত্যন্ত কম—গড়ে ৩ থেকে ৪ শতাংশ। সেখানে ৩৭ শতাংশ শুল্ক এই শিল্পের জন্য মৃত্যুঘণ্টা বয়ে আনবে।’
বাংলাদেশ অ্যাপারেল ইয়ুথ লিডারস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আবরার হোসেন সায়েম বলেন, ‘তরুণ উদ্যোক্তারা এই খাতে বিপুলভাবে যুক্ত হচ্ছেন। কিন্তু বৈশ্বিক বাজারে অনিশ্চয়তা ও উচ্চ শুল্ক আমাদের এই সম্ভাবনাময় খাতের বিস্তারকে বাধাগ্রস্ত করছে। সরকার ও কূটনৈতিক মহলের পক্ষ থেকে দ্রুত পদক্ষেপ ছাড়া এ সংকটের সমাধান সম্ভব নয়।’
বিশেষজ্ঞদের মতে, এই পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে দেশের প্রায় এক হাজার পোশাক কারখানা ঝুঁকিতে পড়বে। কর্মসংস্থান সংকুচিত হবে, যা দেশের অর্থনীতিতে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। তৈরি পোশাকশিল্প দেশের রপ্তানি আয়ের প্রাণভোমরা হলেও আন্তর্জাতিক বাণিজ্য নীতির মারপ্যাঁচে আজ এই খাত অস্তিত্ব সংকটে।
বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশে টিকে থাকতে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানিকারকদের জন্য শুল্কবিহীন প্রবেশাধিকারের সুযোগ নিশ্চিত করা জরুরি হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে যেহেতু বাংলাদেশের পণ্যগুলোর চাহিদা ব্যাপক, সেখানে শুল্কের ভার এই শিল্পের জন্য বড় ধরনের প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে।
কূটনৈতিক সম্পর্ক উন্নয়ন এবং দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য আলোচনার মাধ্যমে শুল্ক সম্পূর্ণ প্রত্যাহারের আহ্বান জানিয়েছে পোশাকশিল্প সংশ্লিষ্টরা। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক মান বজায় রেখে উৎপাদন ব্যয় কমিয়ে আনার পথ খুঁজে বের করার পরামর্শও দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
এই সংকট শুধু একটি খাতের সমস্যা নয়; বরং দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক কাঠামো এবং বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের নিরাপত্তার সঙ্গে জড়িত। ফলে সরকার, বেসরকারি খাত এবং শ্রমিক সংগঠনসমূহকে একযোগে কাজ করে এই সংকট উত্তরণে সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।
উল্লেখ্য, গত কয়েক বছর ধরে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা, কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধি, বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হারের ওঠানামা, শ্রমিক মজুরি বৃদ্ধি এবং বৈশ্বিক বাজারে চাহিদা হ্রাসের কারণে পোশাকশিল্প আগেই চাপে ছিল। তার ওপর যুক্তরাষ্ট্রের এই একতরফা শুল্কারোপ দেশের পোশাকশিল্পের জন্য চূড়ান্ত ধাক্কা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এখনই সময় বাস্তবসম্মত ও দূরদর্শী সিদ্ধান্ত গ্রহণের। কারণ এ শিল্পের ওপর নির্ভর করে দেশের লক্ষাধিক শ্রমিকের জীবিকা এবং বৈদেশিক মুদ্রার স্থিতিশীলতা। এই সংকট উত্তরণে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টায় এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন পোশাকশিল্পের নেতৃবৃন্দ।