অর্থনীতি

মার্কিন পণ্যের উপর শুল্কছাড় দিয়েছে চীন

চীন সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানিকৃত কিছু পণ্যের উপর আরোপিত ১২৫ শতাংশ শুল্ক প্রত্যাহার করে শুল্কমুক্ত ঘোষণা করেছে। এই পদক্ষেপকে মার্কিন-চীন বাণিজ্য যুদ্ধের প্রভাব মোকাবিলা এবং চীনের অর্থনৈতিক উদ্বেগের প্রতিফলন হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। চীনের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ব্যবসায়ী সংস্থাগুলোকে শুল্কমুক্ত পণ্য চিহ্নিত করতে এবং প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহে সহযোগিতা করার জন্য অনুরোধ জানিয়েছে। এই উদ্যোগ বিশ্ববাজারে ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে এবং মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে সম্ভাব্য আলোচনার সূচনা হিসেবে দেখা হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এটি দুই দেশের মধ্যে চলমান উত্তেজনা কমাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।

শুল্কছাড়ের পটভূমি ও তাৎপর্য

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের মধ্যে বাণিজ্য যুদ্ধ গত কয়েক বছর ধরে বিশ্ব অর্থনীতিতে বড় প্রভাব ফেলেছে। ২০২৫ সালের এপ্রিলে চীন মার্কিন পণ্যের উপর ১২৫ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক আরোপ করেছিল, যা যুক্তরাষ্ট্রের ১৪৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে দেখা হয়েছিল। এই পাল্টাপাল্টি শুল্ক আরোপের ফলে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য সম্পর্ক আরও উত্তপ্ত হয়ে ওঠে এবং বিশ্ববাজারে অস্থিরতা বৃদ্ধি পায়। তবে চীনের সাম্প্রতিক শুল্কমুক্ত ঘোষণা এই উত্তেজনা কমানোর একটি সম্ভাব্য পথ দেখাচ্ছে।

চীনের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় একটি টাস্কফোর্স গঠন করেছে, যারা শুল্কমুক্ত করার জন্য উপযুক্ত পণ্যের তালিকা প্রস্তুত করছে। ইতোমধ্যে কিছু মার্কিন পণ্য, যেমন ওষুধ এবং পেট্রোকেমিক্যাল ইথেন, শুল্কমুক্ত সুবিধা পেয়েছে। এই পণ্যগুলো চীনের অর্থনীতি এবং জনস্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। উদাহরণস্বরূপ, চীনের স্বাস্থ্য খাতে আমদানিকৃত ওষুধের উপর নির্ভরশীলতা বেশি, এবং শুল্কমুক্তি এই খাতে খরচ কমাতে সহায়তা করবে।

কনফারেন্স বোর্ডের চায়না সেন্টারের সিনিয়র পরামর্শক আলফ্রেডো মন্টুফার-হেলু এই পদক্ষেপকে ‘কুইড-প্রো-কো’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন, যার অর্থ চীন এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে পারস্পরিক সুবিধার বিনিময়ে এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, “এটি উত্তেজনা কমাতে সাহায্য করতে পারে, তবে উভয় দেশই প্রথমে আলোচনার জন্য হাত বাড়াতে অনীহা প্রকাশ করছে।” এই মন্তব্য থেকে বোঝা যায়, শুল্কমুক্তি কেবল অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত নয়, বরং কূটনৈতিক কৌশলেরও অংশ।

বিশ্ববাজারে শুল্কছাড়ের প্রভাব

চীনের এই শুল্কমুক্ত ঘোষণার পর বিশ্ববাজারে ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। হংকংয়ের হ্যাংসেং সূচক ২.৬৯ শতাংশ এবং জাপানের নিক্কি সূচক ৭.২ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। এছাড়া, দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান এবং অস্ট্রেলিয়ার শেয়ারবাজারেও উল্লেখযোগ্য উত্থান লক্ষ্য করা গেছে। এই প্রবৃদ্ধি ইঙ্গিত দেয় যে বিনিয়োগকারীরা চীনের পদক্ষেপকে বাণিজ্য যুদ্ধে উত্তেজনা হ্রাসের সংকেত হিসেবে গ্রহণ করছেন।

মার্কিন ডলারের মূল্যও শুল্কমুক্ত ঘোষণার পর বৃদ্ধি পেয়েছে। রাশিয়ান রুবলের বিপরীতে ডলারের মান ০.৯ শতাংশ বেড়েছে, যা বৈশ্বিক মুদ্রাবাজারে চীনের এই সিদ্ধান্তের প্রভাবকে প্রতিফলিত করে। তবে, তেলের দামে হ্রাস দেখা গেছে। ব্রেন্ট ক্রুড তেলের দাম প্রতি ব্যারেল ৬৪ ডলারে এবং ডব্লিউটিআই ক্রুড তেলের দাম ৬১.৮২ ডলারে নেমে গেছে। এই দামের হ্রাস বাণিজ্য যুদ্ধের প্রভাবে জ্বালানি বাজারে অস্থিরতার ফল হতে পারে।

চীনের অভ্যন্তরীণ অর্থনীতি ও ব্যবসায়ীদের প্রতিক্রিয়া

চীনের পলিটব্যুরো এক বিবৃতিতে দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যবসায়ীদের সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, বিশেষ করে যেসব প্রতিষ্ঠান শুল্কযুদ্ধের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। শুল্কমুক্ত ঘোষণা এই প্রতিশ্রুতির একটি অংশ হিসেবে দেখা হচ্ছে। চীনের ব্যবসায়ী সংগঠনগুলো এই পদক্ষেপকে স্বাগত জানিয়েছে এবং শুল্কমুক্ত পণ্যের তালিকায় নতুন সংযোজনের জন্য অপেক্ষা করছে।

চীনের অর্থনীতি বর্তমানে একাধিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। আবাসন খাতের সংকট, অঞ্চলভিত্তিক ঋণ এবং তরুণদের মধ্যে বেকারত্বের হার বৃদ্ধি দেশটির অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে মন্থর করেছে। এই পরিস্থিতিতে শুল্কমুক্ত ঘোষণা অভ্যন্তরীণ ব্যবসায়ীদের জন্য কিছুটা স্বস্তি আনতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, পেট্রোকেমিক্যাল ইথেনের মতো পণ্যের শুল্কমুক্তি চীনের শিল্প খাতে উৎপাদন খরচ কমাতে সহায়তা করবে।

মার্কিন-চীন সম্পর্কে সম্ভাব্য প্রভাব

চীনের শুল্কমুক্ত ঘোষণাকে অনেকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে আলোচনার প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে দেখছেন। ট্রাম্প প্রশাসন সম্প্রতি চীনা পণ্যের উপর শুল্ক কমানোর বিষয়ে আলোচনার ইঙ্গিত দিয়েছে, যদি বেইজিংয়ের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় অগ্রগতি হয়। হোয়াইট হাউসের একটি সূত্র জানিয়েছে, শুল্ক কমানোর যেকোনো সিদ্ধান্ত একতরফাভাবে নয়, বরং আলোচনার মাধ্যমে গৃহীত হবে।

তবে, বিশ্লেষকরা সতর্ক করে বলেছেন যে উভয় দেশই আলোচনায় প্রথম পদক্ষেপ নিতে অনীহা প্রকাশ করছে। চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মাও নিং সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বলেছেন, “আমরা চীনা। আমরা উসকানিকে ভয় পাই না। আমরা পিছু হটব না।” এই বক্তব্য চীনের শক্ত অবস্থানের ইঙ্গিত দেয়, যা আলোচনার পথে চ্যালেঞ্জ হিসেবে কাজ করতে পারে।

বিশ্ব অর্থনীতিতে দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) তথ্য অনুসারে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং চীন বিশ্ব অর্থনীতির প্রায় ৪৩ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করে। এই দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য যুদ্ধ বা সমঝোতা বিশ্ব অর্থনীতিতে ব্যাপক প্রভাব ফেলতে পারে। শুল্কমুক্ত ঘোষণা যদি দীর্ঘমেয়াদী আলোচনার পথ প্রশস্ত করে, তবে এটি বিশ্ব বাণিজ্যের স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে সহায়তা করতে পারে।

তবে, যদি আলোচনা ব্যর্থ হয়, তবে পাল্টাপাল্টি শুল্ক আরোপের প্রবণতা অব্যাহত থাকতে পারে, যা বিশ্ববাজারে মূল্যস্ফীতি এবং অর্থনৈতিক মন্দার ঝুঁকি বাড়াবে। বিশ্লেষকদের মতে, চীনের শুল্কমুক্ত ঘোষণা অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হলেও, এর সাফল্য নির্ভর করবে দুই দেশের পারস্পরিক সহযোগিতার উপর।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button