আবহাওয়া

পদ্মা-গড়াইয়ের পানি বিপৎসীমার কাছে, কুষ্টিয়ায় বন্যার আশঙ্কা

ভারী বর্ষণ এবং ভারতের উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের কারণে কুষ্টিয়ায় পদ্মা ও গড়াই নদীর পানি প্রতিদিনই বাড়ছে। জেলার দৌলতপুর, রামকৃষ্ণপুর ও চিলমারীসহ বিস্তীর্ণ এলাকা পানিতে প্লাবিত হয়ে পড়েছে। হাজার হাজার মানুষ এখন পানিবন্দি, বন্ধ হয়ে গেছে একাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, তলিয়ে গেছে ফসলি জমি ও রাস্তাঘাট।

পাবনা পানি উন্নয়ন বোর্ডের ওয়াটার হাইড্রোলজি বিভাগের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, বুধবার (১৩ আগস্ট) দুপুরে হার্ডিঞ্জ ব্রিজ পয়েন্টে পদ্মা নদীর পানি ছিল ১২.৮৯ মিটার, যা বিপৎসীমা (১৩.৮০ মিটার) থেকে মাত্র ১ সেন্টিমিটার নিচে। গড়াই নদীর পানি মাপা হয়েছে ১১.২৭ মিটার, বিপৎসীমার চেয়ে প্রায় দেড় মিটার কম হলেও বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে।

গত এক সপ্তাহে পদ্মা ও গড়াই নদীর পানি গড়ে প্রতিদিন ১০-১৫ সেন্টিমিটার করে বেড়েছে। পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে যেকোনো সময় বিপৎসীমা অতিক্রম করার আশঙ্কা রয়েছে।

দৌলতপুরে ৫০ হাজারেরও বেশি মানুষ পানিবন্দি

দৌলতপুর উপজেলার বিভিন্ন চরাঞ্চল, বিশেষ করে রামকৃষ্ণপুর ও চিলমারী ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চল ইতোমধ্যেই প্লাবিত হয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দাদের মতে, এই দুই ইউনিয়নে অন্তত ৪০ থেকে ৫০ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন।

চরের ভেতরের বহু গ্রামের আবাদি জমি ও সংযোগ সড়ক পানিতে তলিয়ে গেছে। মরিচ, পাট, ধানসহ মৌসুমি ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। কৃষকেরা বলছেন, এই ফসল নষ্ট হলে বছরের সবচেয়ে বড় আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়বেন তারা।

চিলমারীর মানিকের চর, কাশেমের চরসহ একাধিক গ্রামে ইতোমধ্যেই বসতবাড়ির আঙিনায় পানি উঠেছে। অনেকে গবাদিপশু নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছেন। বাথান ভেঙে গরু-মহিষ নিয়ে অনেকে রাস্তা বা উঁচু বাঁধের ওপর অস্থায়ী আশ্রয় নিচ্ছেন।

স্কুল বন্ধ, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের দুশ্চিন্তা

কুষ্টিয়া প্রাথমিক শিক্ষা অফিসের তথ্য অনুযায়ী, শুধু চরের দুই ইউনিয়নের ১৩টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পানি প্রবেশ করায় পাঠদান সম্পূর্ণ বন্ধ রাখা হয়েছে। এর বাইরে আরও কয়েকটি বিদ্যালয় পানির হুমকির মুখে রয়েছে।

প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মোস্তাক আহমেদ জানান, বন্যাপ্রবণ স্কুলগুলোর অবস্থা সরেজমিন পরিদর্শন করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

স্থানীয় অভিভাবকদের আশঙ্কা, এই দীর্ঘস্থায়ী ছুটি শিক্ষার্থীদের পড়াশোনায় মারাত্মক প্রভাব ফেলবে, বিশেষ করে যেসব এলাকায় অনলাইন বা বিকল্প শিক্ষাব্যবস্থা চালু করার সুযোগ নেই।

প্রশাসনের প্রস্তুতি ও ত্রাণ কার্যক্রম

কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসক মো. তৌফিকুর রহমান বলেন,

“আমরা বন্যা মোকাবিলায় পূর্ণ প্রস্তুত আছি। ত্রাণের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। পরিস্থিতি খারাপ হলে দ্রুত ত্রাণ বিতরণ ও পুনর্বাসন কার্যক্রম শুরু করা হবে।”

দৌলতপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আব্দুল হাই সিদ্দিকী জানান, পর্যাপ্ত খাদ্যশস্য মজুদ রয়েছে। পানিবন্দি মানুষের জন্য জরুরি সহায়তা এবং ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য আর্থিক সহায়তার পরিকল্পনা করা হয়েছে।

পদ্মা-গড়াইয়ের পানি বৃদ্ধির কারণ

বিশেষজ্ঞদের মতে, এই হঠাৎ পানির বৃদ্ধি মূলত তিনটি কারণে ঘটছে—

  1. উজানের বৃষ্টিপাত: ভারতের উত্তরাঞ্চলে অতিবৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢল।
  2. নদীর নাব্যতা কমে যাওয়া: খনন কার্যক্রম পর্যাপ্ত না হওয়ায় পানি প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
  3. মৌসুমি বর্ষা: আগস্ট মাসে দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমী বায়ুর সক্রিয়তা বেড়ে যায়, ফলে পদ্মা অববাহিকায় প্রবল বর্ষণ হয়।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, পদ্মা ও গড়াই নদীর পানি কতদিন বাড়তে থাকবে তা এখনো নিশ্চিতভাবে বলা যাচ্ছে না। তবে ভারতের বিভিন্ন নদীভাটিতে পানি বৃদ্ধির ধারা অব্যাহত থাকায় বাংলাদেশের নদীগুলোতেও তার প্রভাব পড়ছে।

অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রভাব

বন্যার কারণে কৃষি, শিক্ষা ও যোগাযোগ ব্যবস্থায় বড় ধরনের বিঘ্ন ঘটেছে। নিম্নাঞ্চলের কৃষকেরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন, কারণ তাদের মরিচ, পাট ও ধানের ক্ষেত ডুবে যাচ্ছে।

গবাদিপশুর খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছে, কারণ চারণভূমি পানিতে তলিয়ে গেছে। ফলে গোখাদ্যের দাম হঠাৎ বেড়ে গেছে। অনেক পরিবারকে পশু বিক্রি করতে হচ্ছে কম দামে।

পানিবন্দি মানুষের জন্য বিশুদ্ধ পানীয় জল, স্বাস্থ্যসেবা ও স্যানিটেশনের সংকট তৈরি হয়েছে। ডায়রিয়া ও চর্মরোগের আশঙ্কাও বাড়ছে।

আগামী দিনের আশঙ্কা

স্থানীয়দের মতে, যদি পানি আরও ২০-৩০ সেন্টিমিটার বাড়ে, তবে বসতবাড়িগুলোতেও পানি ঢুকে পড়বে, যা পুরো এলাকায় তীব্র মানবিক সংকট সৃষ্টি করবে।

এদিকে আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে, আগামী কয়েকদিন দেশের উত্তর ও পশ্চিমাঞ্চলে বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকতে পারে, যা পানি বৃদ্ধির প্রবণতা আরও তীব্র করবে।

পদ্মা ও গড়াই নদীর পানি বৃদ্ধির ফলে কুষ্টিয়ার বিস্তীর্ণ এলাকা বন্যার হুমকিতে রয়েছে। প্রশাসন প্রস্তুত থাকলেও স্থানীয় মানুষের দুশ্চিন্তা কাটছে না। আগামী কয়েকদিন পরিস্থিতি কোন দিকে যাবে, তা নির্ভর করছে উজান থেকে নেমে আসা পানির গতিপ্রবাহ এবং আবহাওয়ার ওপর।

MAH – 12297 ,  Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Advertisement
Back to top button