পেঁয়াজের দাম কেন বাড়ছে: বিস্তারিত বিশ্লেষণ

বাংলাদেশের বাজারে পেঁয়াজের দাম নিয়ে এখন নতুন করে সরগরম। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে, বিশেষ করে পাবনার সাঁথিয়া উপজেলার উৎপাদন এলাকা থেকে শুরু করে রাজধানী ঢাকাসহ সকল বড় বড় শহরে পেঁয়াজের দাম হঠাৎ করেই ব্যাপকভাবে বেড়ে গেছে। ক্রেতা থেকে শুরু করে বিক্রেতা পর্যন্ত সবাই এই অস্থিরতার কারণ খুঁজছে। গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে পেঁয়াজের দাম খুচরা পর্যায়ে প্রতি কেজিতে ২০ থেকে ২৫ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। দেশজুড়ে এখন পেঁয়াজের কেজি দাম ৭৫ থেকে সর্বোচ্চ ৯০ টাকা পর্যন্ত উঠেছে, যা গত এক মাসের তুলনায় উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি।
বাজারে পেঁয়াজের দাম বৃদ্ধির প্রধান কারণগুলো
১. পেঁয়াজ উৎপাদনের পরিমাণ বৃদ্ধি সত্ত্বেও বাজারে সরবরাহের ঘাটতি
সরকারি তথ্য অনুসারে, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে দেশের পেঁয়াজ উৎপাদন হয়েছে ৪৪ লাখ ৪৮ হাজার টন, যা আগের বছরের চেয়ে প্রায় ৫ লাখ ৩৭ হাজার টন বেশি। তবুও কেন দাম বাড়ছে? এর মূল কারণ হল কৃষকদের ঘরে মজুত পেঁয়াজের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি। বৃষ্টির কারণে অনেক পেঁয়াজ নষ্ট হয়ে গেছে। এতে বাজারে পেঁয়াজের সরবরাহ কমে যাওয়ায় দাম বেড়েছে।
২. পেঁয়াজ মজুতদারদের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি
পেঁয়াজের বাজারে মজুতদার ও ব্যবসায়ীদের দাপটও এই মূল্যবৃদ্ধির পেছনে অন্যতম কারণ। বাজারে সরবরাহ কমিয়ে বা হঠাৎ চাহিদা বাড়িয়ে তারা কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করছে, যা দাম বৃদ্ধির পথ প্রশস্ত করছে। পাবনার সাঁথিয়ার বোয়াইলমারী হাটে পেঁয়াজের দাম এক সপ্তাহে প্রতি মণে ৫০০-৭০০ টাকা বেড়েছে।
৩. আমদানি বন্ধ থাকার প্রভাব
প্রতিবছর দেশে পেঁয়াজের সরবরাহ কমে গেলে আমদানি করে ঘাটতি পূরণ করা হয়। কিন্তু বর্তমানে সরকারের আমদানির অনুমতি না থাকার কারণে ভারত থেকে সস্তা পেঁয়াজ আনা সম্ভব হচ্ছে না। ভারতের বাজারে পেঁয়াজের দাম প্রতি কেজি প্রায় ২০ টাকা হলেও আমদানির অনুপস্থিতিতে দেশে দাম কমছে না।
৪. সরকার ও সংশ্লিষ্টদের দ্বন্দ্বপূর্ণ নীতিমালা
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় পেঁয়াজ আমদানির অনুমতি নিয়ে দ্বিধান্বিত। সরকার চাইছে কৃষকদের লোকসানে পড়তে না দেয়া, তাই আমদানির অনুমতি দিচ্ছে না, যা বাজারের অস্থিরতার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বাজার পরিস্থিতি: রাজধানী থেকে জেলার অবস্থা
রাজধানীর মোহাম্মদপুর, টাউনহল, হাতিরপুল, তেজগাঁও, কারওয়ান বাজারসহ বিভিন্ন বড় বাজার ঘুরে দেখা যায়, পাবনার পেঁয়াজ ৮৫ থেকে ৯০ টাকা দামে বিক্রি হচ্ছে। ফরিদপুর ও মানিকগঞ্জ থেকে আসা পেঁয়াজ ৭৫ থেকে ৮০ টাকা দরে পাওয়া যাচ্ছে। এক সপ্তাহ আগেও দাম ছিল ৫৫ থেকে ৬৫ টাকা। এতে স্পষ্ট যে দাম দ্রুতই বৃদ্ধি পাচ্ছে।
কৃষকের দৃষ্টিকোণ: লোকসান আর হতাশা
পেঁয়াজ চাষিরা বলছেন, ভালো দাম পাওয়ার লোভে অনেকেই সময়মতো পেঁয়াজ তুলেননি, ফলে বৃষ্টির কারণে বড় পরিমাণ পেঁয়াজ নষ্ট হয়েছে। রাজা হোসেন নামে একজন আড়তদার জানান, “গত বছর ভালো দাম পেয়েছি বলে এই বছর অনেকেই অপরিপক্ব পেঁয়াজ উঠিয়েছে। সংরক্ষণ ব্যবস্থা ভালো না হওয়ায় পেঁয়াজ নষ্ট হয়েছে।” আরেক চাষি রতন পাল বলেন, “আমি প্রায় ৪০০ মণ পেঁয়াজ মজুত রেখেছিলাম, এর অর্ধেক নষ্ট হয়ে গেছে। এখন দাম বাড়লেও লাভ হচ্ছেনা।”
ভোক্তার দুর্দশা ও অভিযোগ
বাজারে পেঁয়াজের দাম বেড়ে যাওয়ায় ভোক্তারা মারাত্মক ক্ষোভ প্রকাশ করছেন। রাজধানীর মোহাম্মদপুরের সাজেদুল ইসলাম বলেন, “মাত্র পাঁচ-ছয় দিনের মধ্যে পেঁয়াজের দাম ২০ টাকা বেড়েছে। এটা স্বাভাবিক নয়। অন্যান্য খাদ্যপণ্যের দামও বাড়ছে, যা আমাদের দৈনন্দিন জীবন আরও কষ্টকর করে তুলছে।”
সরকারের পদক্ষেপ ও ভবিষ্যতের সম্ভাবনা
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. ছাইফুল আলম জানান, “পেঁয়াজের দাম বৃদ্ধির বিষয়টি আমাদের নজরে এসেছে। আমদানির অনুমতি দিলে কৃষকেরা লোকসানে পড়তে পারেন কি না, সেটি গুরুত্ব সহকারে পর্যালোচনা করা হচ্ছে। আমাদের রিপোর্ট ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো হয়েছে এবং কৃষি ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে।”
এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে বলেন, “বর্তমানে দেশে পেঁয়াজের যথেষ্ট মজুত রয়েছে, বাজারে সরবরাহেও ঘাটতি নেই। কিন্তু বৃষ্টি ও মজুতদারদের দাপটের কারণে দাম বাড়ছে। পরিস্থিতি মনিটরিং করছি, প্রয়োজনে আমদানির অনুমতি দেব।”
পেঁয়াজ আমদানি: কতটা জরুরি?
বর্তমানে ভারতীয় পেঁয়াজের দাম কম থাকায় আমদানির সুযোগ পেলে দাম দ্রুত নিয়ন্ত্রণে আসতে পারে। তবে সরকারের দুশ্চিন্তা কৃষকদের ক্ষতির বিষয়টি বিবেচনা করেই আমদানির সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে। এদিকে, আমদানির অনুমতি না পেলে দেশের বাজারে দাম আরও বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
সাম্প্রতিক প্রবণতা: পেঁয়াজের মূল্য ওঠানামার ইতিহাস
গত বছর এই সময়ে দেশের বাজারে পেঁয়াজের দাম ছিল ১১০ থেকে ১২০ টাকা কেজি দরে, যা এ বছরের তুলনায় অনেক বেশি। তবে তখন আমদানি করা পেঁয়াজের দাম ছিল প্রায় ১০০ থেকে ১১০ টাকা। এ বছর দেশের পেঁয়াজ উৎপাদন বৃদ্ধি পাওয়ায় এখনও পর্যন্ত আমদানির প্রয়োজন হয়নি।
পেঁয়াজ খরচ বৃদ্ধি ও সাধারণ মানুষের প্রভাব
পেঁয়াজ বাংলাদেশের রান্নার অন্যতম অপরিহার্য উপাদান। এর দাম বৃদ্ধির ফলে গড় পরিবারের রান্নাঘরের ব্যয় বাড়ছে। ক্রমবর্ধমান খাদ্য মূল্যবৃদ্ধি ভোক্তাদের আর্থিক চাপ বাড়িয়ে দিচ্ছে। বিশেষ করে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির জন্য এটি বড় ধরনের সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বাংলাদেশের পেঁয়াজ বাজারের এই অস্থিরতা মূলত উৎপাদন, সরবরাহ, বৃষ্টিপাত, মজুতদারদের দাপট এবং আমদানির অনুপস্থিতির জটিল সমন্বয়। পরিস্থিতি দ্রুত স্থিতিশীল না হলে সামগ্রিক খাদ্য নিরাপত্তা ও ভোক্তার স্বার্থে বড় ধরনের সমস্যা দেখা দিতে পারে। সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে দ্রুত কার্যকর ও দীর্ঘমেয়াদী সমাধান গ্রহণ করতে হবে যাতে বাজার নিয়ন্ত্রণে আসে এবং সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ কমে।
MAH – 12249 , Signalbd.com