ডেঙ্গুতে আরও একজনের মৃত্যু, হাসপাতালে ভর্তি ২৮০ জন

দেশজুড়ে ডেঙ্গু পরিস্থিতি আরও অবনতির দিকে যাচ্ছে। গত ২৪ ঘণ্টায় প্রাণঘাতী এই এডিস মশাবাহিত রোগে একজনের মৃত্যু হয়েছে। পাশাপাশি নতুন করে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন আরও ২৮০ জন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম থেকে পাঠানো প্রতিবেদন থেকে এই তথ্য জানা গেছে।
চলতি বছর এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১৮ হাজার ৬২৫ জন। এর মধ্যে মৃত্যু হয়েছে ৭০ জনের।
গত ২৪ ঘণ্টার ডেঙ্গু পরিসংখ্যান
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রকাশিত সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, গতকাল বুধবার সকাল ৮টা থেকে আজ বৃহস্পতিবার সকাল ৮টা পর্যন্ত সময়ে একজন ডেঙ্গু রোগীর মৃত্যু হয়েছে। একই সময়ে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে নতুন করে ২৮০ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হন।
আঞ্চলিক বিবরণ অনুযায়ী:
- বরিশাল বিভাগে (সিটি করপোরেশন ব্যতীত) ৬৬ জন
- ঢাকা মহানগরীতে ৫৪ জন
- চট্টগ্রাম বিভাগে ৪৫ জন
- ঢাকার অন্যান্য জেলায় ৪৪ জন
- রাজশাহী বিভাগে ৩৯ জন
- খুলনা বিভাগে ২৫ জন
- রংপুর বিভাগে ৪ জন
- ময়মনসিংহ বিভাগে ৩ জন
নতুন আক্রান্তদের মধ্যে বেশিরভাগই রাজধানী ও আশপাশের অঞ্চল থেকে। এই সংখ্যাগুলো আগের দিনের তুলনায় কম হলেও সার্বিক পরিস্থিতি এখনও উদ্বেগজনক।
চলতি বছরের ডেঙ্গু পরিস্থিতির সারসংক্ষেপ
২০২৫ সালের শুরু থেকে ২৪ জুলাই পর্যন্ত ডেঙ্গুতে মোট আক্রান্তের সংখ্যা ১৮,৬২৫ জনে পৌঁছেছে। মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৭০ জনে। এর মধ্যে পুরুষ ৩৭ জন এবং নারী ৩৩ জন।
বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, গত বছরের তুলনায় চলতি বছর ডেঙ্গুর প্রকোপ কিছুটা দেরিতে শুরু হলেও সংক্রমণের গতি দ্রুত বেড়েছে। প্রতিদিন গড়ে ২৫০–৩০০ জন আক্রান্ত হচ্ছেন এবং রোগী সংখ্যা বাড়ছে বর্ষা মৌসুমের সঙ্গে সঙ্গে।
মৃতের সংখ্যা বাড়ছে, হাসপাতালগুলোতে চাপ
একজনের মৃত্যু হলেও চিকিৎসকদের মতে এটি আগাম সতর্ক সংকেত। ঢাকাসহ বিভিন্ন হাসপাতাল ডেঙ্গু রোগীতে ভর্তি উপচে পড়ছে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের একজন চিকিৎসক বলেন, “প্রতিদিনই নতুন ডেঙ্গু রোগী আসছেন। অনেকেই সিরিয়াস অবস্থায় আসছেন। বেশিরভাগ রোগী জ্বর এবং প্লেটলেট কমে যাওয়ার সমস্যা নিয়ে ভর্তি হচ্ছেন।”
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অল্প বৃষ্টিতে এডিস মশার প্রজনন ক্ষেত্র তৈরি হওয়ায় সংক্রমণ ছড়াচ্ছে দ্রুত। বাড়ি, অফিস, নির্মাণাধীন ভবন এবং ড্রেনের পাশে জমে থাকা পানি মশা উৎপত্তির প্রধান কারণ।
ডেঙ্গু আক্রান্তদের মধ্যে কারা বেশি ঝুঁকিতে?
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ডেঙ্গুতে আক্রান্তদের মধ্যে বেশি সংখ্যক হচ্ছেন কর্মজীবী পুরুষ এবং শিশু। পুরুষদের আক্রান্ত হওয়ার হার তুলনামূলক বেশি হওয়ায় মৃত্যুর সংখ্যাতেও তা প্রতিফলিত হচ্ছে।
বিশেষ করে যেসব এলাকায় ডেঙ্গুর প্রকোপ বেশি, সেসব এলাকায় শিশু ও বয়স্কদের চিকিৎসা ঝুঁকি আরও বেশি। আগেভাগে চিকিৎসা না পেলে রোগীর শরীরে শক সিনড্রোম বা হেমোরেজিক ফিভার দেখা দিতে পারে, যা প্রাণঘাতী হয়ে উঠতে পারে।
জনসচেতনতার অভাব এবং প্রশাসনিক চ্যালেঞ্জ
ডেঙ্গু রোধে সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগ থাকলেও জনসচেতনতার অভাবে তা কার্যকর হচ্ছে না বলেই মত বিশেষজ্ঞদের। নগরবাসীর অসচেতনতা এবং বাসাবাড়ির ভেতরে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার অভাব ডেঙ্গুর বিস্তারে ভূমিকা রাখছে।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের একজন কর্মকর্তা জানান, “আমরা নিয়মিত মশা নিধনে কাজ করছি। কিন্তু বাসাবাড়ির ভেতরের ফুলের টব, ড্রাম, পুরনো টায়ারে জমে থাকা পানিতে এডিস মশা জন্ম নিচ্ছে। জনসচেতনতা ছাড়া এটি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়।”
এছাড়াও, সঠিক সময়ে লার্ভিসাইড প্রয়োগ না হওয়া, বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনে বিলম্ব, এবং পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রমে সমন্বয়ের ঘাটতিও পরিস্থিতিকে জটিল করে তুলেছে।
ডেঙ্গু প্রতিরোধে করণীয় কী?
চিকিৎসক ও স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডেঙ্গু রোধে প্রতিটি নাগরিককে সচেতন হতে হবে। নিয়মিতভাবে বাড়ির আশপাশ পরিষ্কার রাখা, জমে থাকা পানি সরানো, ফুলের টব বা ড্রামে পানি জমতে না দেওয়া, এবং সাপ্তাহিকভাবে একবার করে বাড়ির প্রতিটি কোণ ভালোভাবে পরীক্ষা করার পরামর্শ দিয়েছেন।
ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণ দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি। প্রাথমিকভাবে হালকা জ্বর, মাথাব্যথা, চোখের পেছনে ব্যথা, মাংসপেশিতে ব্যথা, এবং শরীরে লাল দাগ দেখা দিতে পারে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে বলা হয়েছে, কেউ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলে ঘরে বিশ্রাম, প্রচুর পানি পান এবং নিয়মিত প্লেটলেট কাউন্ট পর্যবেক্ষণের পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।
সারসংক্ষেপ
ডেঙ্গু পরিস্থিতি বর্তমানে নিয়ন্ত্রণযোগ্য মনে হলেও প্রতিদিনের নতুন সংক্রমণ ও মৃত্যুর ঘটনা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে যে, যথাযথ প্রতিরোধ না নিলে পরিস্থিতি দ্রুত ভয়াবহ রূপ নিতে পারে। এখনই জনসচেতনতা বৃদ্ধি, প্রশাসনের কার্যকর পদক্ষেপ এবং চিকিৎসা ব্যবস্থার প্রস্তুতি জোরদার করতে হবে।
তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, আগামী সপ্তাহগুলোতে বৃষ্টিপাত আরও বাড়তে পারে — যার ফলে সংক্রমণ আরও বাড়ার শঙ্কা রয়েছে। সময় থাকতে সক্রিয় না হলে বিপর্যয় এড়ানো কঠিন হবে।
এম আর এম – ০৫০৩ , Signalbd.com