বিশ্ব

ইরানে হামলার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের অনুমতি দরকার পড়েনি ইসরায়েলের

ইসরায়েলের সাবেক রাষ্ট্রদূত মাইকেল ওরেন সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে দাবি করেছেন, ইসরায়েল ইরানের বিরুদ্ধে কোনো সামরিক অভিযান বা হামলার জন্য যুক্তরাষ্ট্র থেকে আলাদা কোনো ‘সবুজ সংকেত’ বা অনুমতি চায়নি। মাইকেল ওরেন মূলত যুক্তরাষ্ট্রে ইসরায়েলের রাষ্ট্রদূত হিসেবে দীর্ঘকাল কাজ করেছেন, তাই তার এই বক্তব্য আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে নতুন মাত্রা যোগ করেছে।

যুক্তরাষ্ট্র-ইসরায়েল সম্পর্কের গোপন কৌশল

সাবেক রাষ্ট্রদূত মাইকেল ওরেন বলেন, “ইসরায়েল যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে এত নিবিড় সম্পর্ক বজায় রাখতে পেরেছে কারণ যুক্তরাষ্ট্রে একটি বিশাল ইহুদি জনগোষ্ঠী রয়েছে, যারা ইসরায়েলের ওপর রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম।” তিনি আরও বলেন, “এদেশে কিছু বিরোধী মতামত থাকলেও, ইসরায়েলকে সমর্থন করার জন্য শক্তিশালী ভিত্তি রয়েছে। এই কারণেই ইসরায়েল যুক্তরাষ্ট্রের মধ্য দিয়ে নিজের নিরাপত্তা ও কূটনৈতিক স্বার্থ নিশ্চিত করতে পারছে, যা অন্য অনেক দেশের পক্ষে সম্ভব নয়।”

তিনি অমেরিকান প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার আত্মজীবনী উদাহরণ দিয়ে বলেন, “ওবামা নিজে তার বইতে উল্লেখ করেছেন, ‘আমি যা ইচ্ছা করতে পারতাম, সেটা সব ক্ষেত্রেই নয়, বিশেষত ইসরায়েলের ব্যাপারে। এটা শুধু আমার সীমাবদ্ধতা নয়, বরং বিশেষ কিছু কারণ রয়েছে।’”

ট্রাম্প প্রশাসনের সময় সম্পর্কের স্বচ্ছতা

মাইকেল ওরেন আরও বলেন, “ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন এবং ইসরায়েলের মধ্যে সম্পর্ক ছিলো অনেক বেশি ঘনিষ্ঠ ও সমর্থনশীল। আমরা অনেক বিষয়ে একমত ছিলাম, এবং দু’দেশের মধ্যে কোন বড় সমস্যা ছিল না। এমনকি অনেক সময় এমনও হয় যে, অনুমতি নেওয়ার বা অনুমোদন চাওয়ার দরকার পড়ে না।”

তিনি যোগ করেন, “ট্রাম্প বুঝতেন ইসরায়েলের অস্তিত্বগত নিরাপত্তা কতটা গুরুত্বপূর্ণ। তাই তিনি যে কোনো সামরিক পদক্ষেপে ইসরায়েলের পাশে দাঁড়িয়েছেন। ফলে ইসরায়েল স্বাধীনভাবে এবং দ্রুততার সঙ্গে পদক্ষেপ নিতে পেরেছে।”

ইসরায়েলের নিরাপত্তা কৌশল ও ইরানের প্রতি হুমকি

ইসরায়েল বহু বছর ধরেই ইরানকে তার নিরাপত্তার প্রধান হুমকি হিসেবে বিবেচনা করে আসছে। ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি ও মধ্যপ্রাচ্যে তার প্রভাব বিস্তার ইসরায়েলের জন্য অগ্রাধিকার বিষয়। এই কারণেই ইসরায়েল কখনো কখনো এককভাবে ইরানের বিরুদ্ধে কূটনৈতিক ও সামরিক পদক্ষেপ নিয়েছে।

বিশ্লেষকরা মনে করেন, ইসরায়েল যদি ইরানে হামলার সিদ্ধান্ত নেয়, তবে তা যুক্তরাষ্ট্রের সরাসরি অনুমতি ছাড়াই নিতে পারে, কারণ দু’দেশের মধ্যে একটি অঘোষিত কিন্তু দৃঢ় বোঝাপড়া কাজ করে। যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক পরিবেশ ও বিভিন্ন শাখায় ইসরায়েল সমর্থকদের শক্তিশালী উপস্থিতি এটিকে সম্ভব করেছে।

যুক্তরাষ্ট্রে ইসরায়েল সমর্থনের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট

যুক্তরাষ্ট্রে ইসরায়েলকে সমর্থন করার পেছনে রয়েছে বহু রাজনৈতিক, সামাজিক ও ঐতিহাসিক কারণ। দেশটির বিশাল ইহুদি ডায়াস্পোরা, ইসরায়েলের প্রতি ধারাবাহিক রাজনৈতিক সমর্থন, লবিস্ট গোষ্ঠী ও মিডিয়া প্রভাব এ ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা পালন করে।

বিশ্লেষকরা বলেন, “যুক্তরাষ্ট্রে ইসরায়েলের প্রতি সমর্থন মূলত দুই দিক থেকে আসছে — এক, দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অবস্থা, দুই, বাইরের কূটনৈতিক ও সামরিক স্বার্থ।” এ কারণে ইসরায়েল আমেরিকান নীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রেও এক গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার।

ওবামা এবং ট্রাম্প প্রশাসনের পার্থক্য

বারাক ওবামা আমলে যুক্তরাষ্ট্র-ইসরায়েল সম্পর্ক তুলনামূলকভাবে জটিল ছিল। ওবামার নীতিতে ইরানের সঙ্গে আলোচনা ও পারমাণবিক চুক্তি (জিসিপিপি) অন্যতম ছিল। যা ইসরায়েলের অনেক ক্ষেত্রে বিপরীতমুখী ছিল। ফলে ওবামার আমলে দুই দেশের মধ্যে কিছু মতানৈক্য দেখা দিয়েছিল।

অপরদিকে, ট্রাম্প প্রশাসন ইসরায়েলের প্রতি বিশেষ সমর্থন দেখিয়েছে। ট্রাম্প আমলে মার্কিন কূটনীতিতে ইসরায়েলকে অনেক বেশি স্বাধীনতা ও সামরিক সহযোগিতা দেওয়া হয়েছে। ট্রাম্পের সিদ্ধান্তে যেমন আমেরিকার দূতাবাস জেরুজালেমে স্থানান্তর, তেমনি ইরানের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহন ইসরায়েলের নিরাপত্তা নীতিকে অনেকাংশে স্বাগত জানিয়েছে।

ইসরায়েলের স্বাধীন পদক্ষেপের পরিপ্রেক্ষিত

মাইকেল ওরেনের বক্তব্য অনুযায়ী, “ইসরায়েল কখনোই অন্য দেশের অনুমতির বন্দী নয়, বিশেষ করে যখন তার অস্তিত্ব ও নিরাপত্তার প্রশ্ন আসে। তাদের স্বাধীন পদক্ষেপ নেওয়ার অধিকার আছে।”

এই স্বাধীনতা ইসরায়েলের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক পরিস্থিতি তীব্র এবং দ্রুত পরিবর্তনশীল। তাই দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন।

ইরান-ইসরায়েল সম্পর্কের ভবিষ্যত

বিশ্লেষকরা মনে করেন, ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে বৈরিতার তীব্রতা এখনও অব্যাহত থাকবে। ইরানের পারমাণবিক সামরিক সক্ষমতা বৃদ্ধির প্রতি বিশ্ব সম্প্রদায়ের উদ্বেগ বাড়ছে, এবং ইসরায়েল তা রোধে সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

এই পরিস্থিতিতে, ইসরায়েলকে যুক্তরাষ্ট্রের পূর্ণ সমর্থন পেলে বা না পেলেও তার পদক্ষেপ নেওয়ার স্বাধীনতা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।

সারসংক্ষেপ

  • ইসরায়েল ইরানে হামলার জন্য যুক্তরাষ্ট্র থেকে আলাদা অনুমতি চায়নি।
  • যুক্তরাষ্ট্রে ইসরায়েল সমর্থকদের প্রভাব এতটাই শক্তিশালী, যা দুই দেশের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রাখে।
  • বারাক ওবামা আমলে সম্পর্ক কিছুটা জটিল ছিল, ট্রাম্প আমলে অধিক সমর্থন ছিল।
  • ইসরায়েল স্বাধীনভাবে দ্রুত ও কার্যকর পদক্ষেপ নিতে সক্ষম।
  • মধ্যপ্রাচ্যের নিরাপত্তা পরিস্থিতি ও ইরান-ইসরায়েল দ্বন্দ্ব অব্যাহত থাকবে।
মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Advertisement
Back to top button