আঞ্চলিক

সেতুর অভাবে ৫ গ্রামের মানুষের একমাত্র ভরসা বাঁশের সাঁকো

সড়ক নয়, বাঁশের সাঁকোই ভরসা—এক সেতুর অভাবে চরম দুর্ভোগে পড়েছেন গাইবান্ধার পলাশবাড়ী উপজেলার কিশোরগাড়ি ইউনিয়নের পাঁচটি গ্রামের হাজারো মানুষ। করতোয়া নদীর ওপর সেতু না থাকায় প্রতিদিন ঝুঁকি নিয়ে পারাপার হতে হচ্ছে বাঁশের তৈরি সাঁকো দিয়ে।

গণকপাড়া, মুংলিশপুর, পালপাড়া, শীলপাড়া, জাফর এবং জাইতর—এই পাঁচ গ্রামের মানুষ বছরের পর বছর ধরে ওলির ঘাটে একটি সেতুর জন্য অপেক্ষা করে আসছেন। স্থানীয়দের ভাষ্য, একাধিকবার জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসনের পক্ষ থেকে আশ্বাস দেওয়া হলেও বাস্তবে কোনো সেতু নির্মিত হয়নি। ফলে প্রতিদিনই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পাড়ি দিতে হচ্ছে নদী।

সাঁকোই যেখানে একমাত্র ভরসা

পলাশবাড়ীর গণকপাড়া গ্রামের করতোয়া নদীর ওলির ঘাটে বাঁশের তৈরি অস্থায়ী সাঁকোই বর্তমানে একমাত্র যাতায়াতের মাধ্যম। বর্ষা মৌসুমে সেই সাঁকোও ভেসে যায় বা ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়ে। তখন স্থানীয়রা নির্ভর করেন একটি ছোট ডিঙ্গি নৌকার ওপর। কিন্তু সেই নৌকার কোনো মাঝিও নেই।

স্থানীয়রা নিজেরাই রশি টেনে নৌকা চালান বা হাঁটু পানি ভেঙে উঠতে হয় পাড়ে। অনেক সময় নৌকাও পাওয়া যায় না, তখন বাধ্য হয়ে কয়েক কিলোমিটার ঘুরে যেতে হয় গন্তব্যে।

বিশেষ করে শিক্ষার্থী, কৃষক ও বাজারে যাতায়াতকারী নারী-পুরুষেরা পড়েন চরম দুর্ভোগে। স্কুল-কলেজগামী শিক্ষার্থীরা প্রতিদিন এই সাঁকো দিয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করে।

সেতু না থাকায় ২ কিলোমিটারের রাস্তা ঘুরে হচ্ছে ৮ কিলোমিটার

স্থানীয়রা জানান, ওলির ঘাট পেরিয়ে পার্শ্ববর্তী দিনাজপুর জেলার ঘোড়াঘাট মাত্র ২ কিলোমিটার দূরে। কিন্তু সেতু না থাকায় সেই পথ ঘুরে ৮ কিলোমিটার দীর্ঘ হয়ে যায়। এতে সময় ও খরচ—দুটোই বাড়ে। রোগী পরিবহন বা জরুরি প্রয়োজনে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হয়ে ওঠে।

দুর্ভোগের কথা বললেন ভুক্তভোগীরা

গণকপাড়া গ্রামের বাসিন্দা সবুজ মিয়া বলেন,
‘অনেক বছর ধরেই এই ঘাটে একটি সেতু নির্মাণের দাবি জানিয়ে আসছি। জনপ্রতিনিধিরা প্রতিবার নির্বাচনের সময় আশ্বাস দেন। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয় না। বর্ষায় নৌকাও মেলে না, তখন অসুস্থ মানুষ নিয়ে হাসপাতালে যাওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে।’

স্থানীয় কৃষক আমিনুল ইসলাম বলেন,
‘বাজারে যাওয়ার সময় সাইকেল কাঁধে করে সাঁকো পার হতে হয়। ভয় লাগে কখন পা ফসকে নদীতে পড়ে যাই। প্রতিদিনকার যাতায়াতে এত কষ্ট—একটি সেতু হলে আমাদের জীবন অনেক সহজ হতো।’

জনপ্রতিনিধিরা কী বলছেন?

কিশোরগাড়ি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবু বক্কর সিদ্দিক বলেন,
‘এই ঘাটে একটি সেতু হলে পলাশবাড়ী ও ঘোড়াঘাটের মধ্যে যোগাযোগ অনেক সহজ হতো। এলাকার কৃষকরা সহজে ফসল বাজারজাত করতে পারতেন। শিক্ষার্থীরা নিরাপদে যাতায়াত করতে পারত। সেতুটি বাস্তবায়ন হলে এলাকার সার্বিক উন্নয়ন তরান্বিত হবে।’

প্রকৌশল বিভাগ কী জানাচ্ছে?

পলাশবাড়ী উপজেলা প্রকৌশলী তপন চক্রবর্তী বলেন,
‘আমরা ইতোমধ্যে জরুরি ভিত্তিতে ওলির ঘাট এলাকায় সেতু নির্মাণের জন্য ফাইল পাঠিয়েছি এবং সার্ভেও করা হয়েছে। আশা করছি, দ্রুত সময়ের মধ্যে প্রকল্পটি অনুমোদন হবে এবং নির্মাণ কাজ শুরু করা যাবে।’

উন্নয়নের বাইরে পড়ে থাকা একটি এলাকা

গাইবান্ধার এই অংশটি এখনও উন্নয়নের মূল স্রোত থেকে অনেকটাই পিছিয়ে রয়েছে। যথাযথ অবকাঠামো না থাকায় শিক্ষা, চিকিৎসা, কৃষিপণ্য বিপণন ও নিত্য যাতায়াতের সব কিছুতেই এখানে মানুষের দুর্ভোগ অনেক বেশি। একটি মাত্র সেতু এখানে যোগাযোগ ব্যবস্থায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে পারে বলে মনে করছেন স্থানীয়রা।

একজন প্রবীণ বাসিন্দা বলেন,
‘সেতুর দাবি নতুন নয়। আমার ছোটবেলা থেকেই শুনছি এই ঘাটে সেতু হবে। এখন বয়স ষাট, কিন্তু সেতু আর হলো না। এর চেয়ে দুঃখজনক আর কী হতে পারে!’

গাইবান্ধার পলাশবাড়ীর পাঁচটি গ্রামের মানুষ করতোয়া নদীর ওপর একটি সেতুর জন্য বছরের পর বছর অপেক্ষা করে আসছে। বাঁশের সাঁকো দিয়ে চলাচল করে তারা প্রতিদিন জীবনের ঝুঁকি নিচ্ছে। উন্নত যোগাযোগ, নিরাপদ যাতায়াত ও অর্থনৈতিক অগ্রগতির স্বার্থে এই সেতু এখন সময়ের দাবি। প্রশাসন ও সরকারের উচিত দ্রুততম সময়ের মধ্যে এই সমস্যার স্থায়ী সমাধান নিশ্চিত করা।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button