বানিজ্য

যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ কোরিয়া বাণিজ্য চুক্তি শুল্ক কমে ১৫ শতাংশ

গত কয়েক মাসের দীর্ঘ অপেক্ষা শেষে অবশেষে যুক্তরাষ্ট্র ও দক্ষিণ কোরিয়ার মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষর হলো, যা আগামী ১ আগস্ট থেকে কার্যকর হবে। এই চুক্তির মাধ্যমে দক্ষিণ কোরিয়ার পণ্যের ওপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ১৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করবে, যা আগের ঘোষণার তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে কম। অন্যদিকে, মার্কিন রপ্তানি পণ্যের ওপর কোনো শুল্ক আরোপ করা হয়নি।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ট্রুথ সোশ্যালে এই বাণিজ্য চুক্তির ঘোষণা দেন এবং বলেন, এটি একটি ‘সম্পূর্ণ ও পূর্ণাঙ্গ’ চুক্তি, যা দুই দেশের মধ্যে অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ককে নতুন দিগন্তে নিয়ে যাবে।

বাণিজ্য চুক্তির মূল বিষয়সমূহ

১. শুল্ক কমানো: দক্ষিণ কোরিয়ার পণ্যের ওপর শুল্ক ২৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১৫ শতাংশে আনা হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে দক্ষিণ কোরিয়ার আমদানিতে কোনো শুল্ক আরোপ করা হয়নি।
২. বিশাল বিনিয়োগ: দক্ষিণ কোরিয়া যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ৩৫০ বিলিয়ন ডলার (৩৫ হাজার কোটি) বিনিয়োগ করবে। এই বিনিয়োগে মার্কিন মালিকানা ও নিয়ন্ত্রণ থাকবে।
৩. জ্বালানি আমদানি: দক্ষিণ কোরিয়া যুক্তরাষ্ট্র থেকে ১০০ বিলিয়ন ডলারের তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) এবং অন্যান্য জ্বালানি পণ্য কিনবে।
৪. অর্থনৈতিক সহযোগিতা: দক্ষিণ কোরিয়া যুক্তরাষ্ট্রে ‘বড় অঙ্কের’ বিনিয়োগের জন্য সম্মত হয়েছে, যার ফলে দুই দেশের মধ্যে অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সহযোগিতা আরও শক্তিশালী হবে।

দুই দেশের অর্থনৈতিক সম্পর্কের নতুন দিগন্ত

দক্ষিণ কোরিয়া এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার বাণিজ্যিক সম্পর্ক গত কয়েক দশকে ক্রমাগত উন্নত হচ্ছে। ২০১৮ সালে দুদেশের মধ্যে বাণিজ্য যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে সম্পর্ক কিছুটা উত্তেজনাপূর্ণ ছিল, বিশেষ করে শুল্ক আরোপের মাধ্যমে। তবে এ নতুন চুক্তি সেই অনিশ্চয়তা দূর করে দুই দেশের অর্থনীতিকে লাভবান করবে বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন।

বিশেষজ্ঞদের মতে, দক্ষিণ কোরিয়ার বৃহৎ বিনিয়োগ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিকে উজ্জীবিত করবে এবং নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে। পাশাপাশি, এলএনজি আমদানির মাধ্যমে মার্কিন জ্বালানি খাতও লাভবান হবে। এর ফলে দুই দেশের মধ্যে কেবল বাণিজ্য নয়, শক্তি নিরাপত্তার ক্ষেত্রেও সহযোগিতা বৃদ্ধি পাবে।

রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ও এর প্রভাব

গত বছর দক্ষিণ কোরিয়ায় রাজনৈতিক অস্থিরতা বেশ বেড়েছিল। সাবেক প্রেসিডেন্ট ইউন সুক-ইওলের সামরিক আইন জারি ও অন্যান্য ইস্যুতে দেশটি বেশ খানিকটা অস্থিতিশীল হয়ে পড়েছিল। এর প্রভাবে দেশটির অর্থনীতি ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কেও প্রভাব পড়েছিল।

গত জুনে লি জে-মিয়ং নতুন প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেন এবং তার নেতৃত্বে দ্রুতই দক্ষিণ কোরিয়া রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরে পায়। ট্রাম্পের সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তি হওয়ায় দেশের বাজার ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে আস্থা ফিরে এসেছে।

ট্রাম্পের নতুন শুল্ক নীতিমালা এবং এর প্রভাব

আগামী ১ আগস্ট থেকে কয়েক ডজন দেশের ওপর ট্রাম্প নতুন শুল্ক আরোপের পরিকল্পনা করছিলেন। তার মধ্যে দক্ষিণ কোরিয়াও ছিল। তবে বাণিজ্য চুক্তির মাধ্যমে দক্ষিণ কোরিয়ার পণ্যের ওপর ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের পরিকল্পনা বাতিল হয়েছে। এই শুল্ক কমানোর ফলে দক্ষিণ কোরিয়ার ইস্পাত, অ্যালুমিনিয়াম, যানবাহন ও পরিবহন যন্ত্রাংশ খাত বড়সড় সুবিধা পাবে।

এর ফলে দক্ষিণ কোরিয়া মার্কিন বাজারে প্রতিযোগিতামূলক সুবিধা পাবে, যা তাদের শিল্প ও অর্থনীতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট লি জে-মিয়ংয়ের বক্তব্য

বাণিজ্য চুক্তি বিষয়ে লি জে-মিয়ং বলেন, “এই চুক্তি আমাদের সব ধরনের অনিশ্চয়তা দূর করবে। এটি নিশ্চিত করবে যে, আমরা আমাদের প্রতিযোগীদের তুলনায় সমান বা কম শুল্ক দিয়ে আমদানি করতে পারব, যা আমাদের শিল্প ও অর্থনীতিকে শক্তিশালী করবে।”

তিনি আরও যোগ করেন, “আমরা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি ও স্থিতিশীল বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।”

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ও দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক

দুটি দেশের মধ্যে ইতোমধ্যে আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে হোয়াইট হাউসে দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট লি জে-মিয়ংয়ের সফর নির্ধারিত রয়েছে। সেখানে আরো বিস্তারিত বিনিয়োগ ও বাণিজ্য বিষয়ক আলোচনার পাশাপাশি নিরাপত্তা, প্রযুক্তি ও শিক্ষা ক্ষেত্রে সহযোগিতা প্রসারিত করার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হবে।

বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এই সফর দুই দেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বন্ধনকে আরো দৃঢ় করবে এবং পরবর্তী দশকে দক্ষিণ কোরিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার সম্পর্ককে ‘স্ট্র্যাটেজিক পার্টনারশিপ’ পর্যায়ে উন্নীত করবে।

সার্বিক প্রভাব ও বিশ্ব বাণিজ্যে গুরুত্ব

এই বাণিজ্য চুক্তি শুধু দক্ষিণ কোরিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের জন্যই নয়, পুরো বিশ্ব বাণিজ্যের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ইঙ্গিত বহন করে। কারণ, এর মাধ্যমে প্রতিযোগিতামূলক ও ভারসাম্যপূর্ণ বাণিজ্যের একটি উদাহরণ তৈরি হয়েছে, যা অন্যান্য দেশের জন্যও পথপ্রদর্শক হতে পারে।

বিশ্ব বাজারে দক্ষিণ কোরিয়ার পণ্যের শুল্ক কমে গেলে, অন্যান্য এশীয় ও পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতায় তাদের অবস্থান শক্ত হবে। একই সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও লাভবান হবে বৃহৎ বিনিয়োগ ও জ্বালানি আমদানির মাধ্যমে।

সারসংক্ষেপ

  • যুক্তরাষ্ট্র ও দক্ষিণ কোরিয়ার মধ্যে ‘সম্পূর্ণ ও পূর্ণাঙ্গ’ বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষর।
  • দক্ষিণ কোরিয়ার পণ্যের ওপর শুল্ক কমে ২৫% থেকে ১৫%।
  • মার্কিন রপ্তানিতে শুল্ক মুক্তি।
  • দক্ষিণ কোরিয়া যুক্তরাষ্ট্রে ৩৫০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করবে।
  • ১০০ বিলিয়ন ডলারের এলএনজি ও জ্বালানি আমদানি।
  • রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির নতুন দিগন্ত।
  • আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে প্রেসিডেন্ট লি জে-মিয়ংয়ের হোয়াইট হাউস সফর।

কীভাবে প্রভাব ফেলবে বাংলাদেশসহ অন্যান্য দেশের ওপর?

বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশ এই চুক্তির মাধ্যমে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে নতুন চ্যালেঞ্জ ও সুযোগের মুখোমুখি হবে। দক্ষিণ কোরিয়ার শুল্ক কমানোর ফলে এশীয় পণ্যের বাজারে প্রতিযোগিতা বেড়ে যাবে, যা বাংলাদেশী পণ্যের মান ও খরচকে প্রভাবিত করতে পারে।

তবে এর সঙ্গে মান উন্নয়ন, প্রযুক্তি বিনিয়োগ ও বাজার সম্প্রসারণের সুযোগও সৃষ্টি হতে পারে। বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের জন্য প্রয়োজন হবে নতুন কৌশল ও বিশ্বমানের পণ্যের উন্নয়ন, যাতে তারা বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারেন।

দক্ষিণ কোরিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের এই বাণিজ্য চুক্তি শুধু দুই দেশের জন্যই নয়, গোটা বিশ্ব বাণিজ্যের জন্য একটি ইতিবাচক সংকেত। এটি আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের নতুন পথ তৈরিতে সহায়ক হবে, এবং দুই দেশের অর্থনীতি, কর্মসংস্থান ও প্রযুক্তিগত অগ্রগতিতে ব্যাপক ভূমিকা রাখবে।

এই চুক্তির সফল বাস্তবায়নের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে আরও স্থিতিশীলতা আসবে এবং অন্যান্য দেশও শুল্ককরণ ও বিনিয়োগ নীতিতে নমনীয়তা প্রদর্শন করবে বলে আশা করা যাচ্ছে।

 MAH – 12044, Signalbd.com

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button