স্কুল-কলেজে মোবাইল ফোন নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত

চুয়াডাঙ্গার জীবননগর উপজেলায় স্কুল ও কলেজ পর্যায়ে মোবাইল ফোন ব্যবহার নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। মঙ্গলবার (১৯ আগস্ট ২০২৫) উপজেলা প্রশাসনের আয়োজিত আইনশৃঙ্খলা কমিটির মাসিক সভায় এ সিদ্ধান্ত সর্বসম্মতভাবে গৃহীত হয়।
সভায় উপস্থিত শিক্ষক, জনপ্রতিনিধি, প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও স্থানীয় বিভিন্ন সংগঠনের প্রতিনিধি একমত হন যে, কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে অতি মাত্রায় মোবাইল ব্যবহারের কারণে পড়াশোনায় মনোযোগ কমছে, নৈতিক অবক্ষয় বাড়ছে এবং বিভিন্ন সামাজিক সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে।
কিভাবে এই সিদ্ধান্ত এলো
সভায় জীবননগর ডিগ্রি কলেজের প্রভাষক জাহাঙ্গীর আলম স্কুল-কলেজে মোবাইল নিষিদ্ধের প্রস্তাব দেন। প্রস্তাবটি দ্রুত সবার সমর্থন লাভ করে। সভায় সভাপতিত্ব করেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আল আমীন।
তিনি বলেন,
“সম্প্রতি পাশের উপজেলা মহেশপুরেও একই ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। জীবননগরে শিক্ষার্থীদের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছিল। আজকের সভায় সর্বসম্মত মতামতের ভিত্তিতে রেজুলেশন গৃহীত হয়েছে। এখন থেকে জীবননগরের প্রতিটি স্কুল ও কলেজে মোবাইল ফোন বহন বা ব্যবহার করা যাবে না।”
মোবাইল নিষিদ্ধের কারণ
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মোবাইল ফোন একদিকে শিক্ষার গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হলেও, অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার শিক্ষার্থীদের জন্য ক্ষতিকর হয়ে দাঁড়িয়েছে।
- পড়াশোনায় মনোযোগ কমে যাওয়া – ক্লাস চলাকালীন শিক্ষার্থীরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বেশি সময় ব্যয় করছে।
- গেম ও ভিডিও আসক্তি – টিকটক, ফ্রি ফায়ার, পাবজি’র মতো গেমে ডুবে যাচ্ছে কিশোর-কিশোরীরা।
- ইভটিজিং ও অপরাধে ব্যবহার – অনেক ক্ষেত্রে মোবাইল ব্যবহারের মাধ্যমে অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে।
- মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা – দীর্ঘ সময় স্ক্রিনে থাকার কারণে শিক্ষার্থীদের মধ্যে হতাশা, ঘুমের সমস্যা ও উদ্বেগ বাড়ছে।
শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের প্রতিক্রিয়া
মোবাইল নিষিদ্ধের সিদ্ধান্তকে কেউ সমর্থন করছে, আবার কেউ সমালোচনাও করছে।
- শিক্ষার্থী দিয়া খাতুন (এসএসসি পরীক্ষার্থী):
“মোবাইল না থাকলে পড়াশোনায় মনোযোগ বাড়বে। তবে অনলাইন ক্লাস বা শিক্ষামূলক তথ্য জানার ক্ষেত্রেও মোবাইল দরকার।” - অভিভাবক আবদুল কাদের:
“আমি এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাই। কারণ এখনকার বাচ্চারা পড়ার চেয়ে মোবাইলেই বেশি সময় কাটায়।” - একজন কলেজ শিক্ষার্থী (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক):
“শুধু নিষিদ্ধ করলে হবে না। শিক্ষকরা যদি সঠিকভাবে পড়াশোনায় উৎসাহিত করেন, তবে আমরা মোবাইল ছেড়ে বইয়ে মন দিতে পারব।”
বাংলাদেশে মোবাইল ব্যবহারের বর্তমান চিত্র
বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) তথ্যমতে, দেশে বর্তমানে ১৯ কোটির বেশি মোবাইল সিম ব্যবহার হচ্ছে। এর মধ্যে কিশোর-কিশোরীরাই সবচেয়ে দ্রুতগতিতে স্মার্টফোন ব্যবহার করছে।
বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে—
- ১২ থেকে ১৮ বছর বয়সী শিক্ষার্থীদের ৭০% প্রতিদিন ৪ ঘণ্টার বেশি সময় মোবাইলে কাটায়।
- ৪৫% শিক্ষার্থী রাতে দেরি করে মোবাইল ব্যবহার করে ঘুমের সমস্যা তৈরি করছে।
- ৩০% শিক্ষার্থী পরীক্ষার প্রস্তুতির সময়েও মোবাইল গেম বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সক্রিয় থাকে।
বিশ্বের অন্যান্য দেশে পরিস্থিতি
শুধু বাংলাদেশ নয়, উন্নত দেশগুলোতেও স্কুলে মোবাইল ব্যবহারের ওপর কড়াকড়ি রয়েছে।
- ফ্রান্সে ২০১৮ সালে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে মোবাইল পুরোপুরি নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
- ভারতে দিল্লি, মহারাষ্ট্রসহ বেশ কয়েকটি রাজ্যে স্কুলে মোবাইল ব্যবহার সীমিত বা নিষিদ্ধ।
- জাপানে ক্লাসরুমে মোবাইল ফোন রাখা যায় না, শুধু জরুরি প্রয়োজনে ব্যবহার করা যায়।
এমন বাস্তবতায় জীবননগরের এই সিদ্ধান্ত আন্তর্জাতিক নীতির সঙ্গেও সঙ্গতিপূর্ণ।
বিশেষজ্ঞদের মতামত
- শিক্ষাবিদ ড. আনিসুজ্জামান:
“মোবাইলকে পুরোপুরি নিষিদ্ধ না করে নিয়ন্ত্রিতভাবে ব্যবহার করা উচিত। কারণ শিক্ষা ক্ষেত্রে প্রযুক্তি অপরিহার্য।” - মনোবিজ্ঞানী ড. লুবনা ফেরদৌস:
“অতিরিক্ত মোবাইল ব্যবহার কিশোরদের মস্তিষ্কে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। আসক্তি থেকে বের হতে সময় লাগে। তাই স্কুল-কলেজে এ ধরনের পদক্ষেপ দরকার।”
ইতিবাচক প্রভাব
- পড়াশোনায় মনোযোগ বাড়বে।
- ইভটিজিং ও অনলাইন অপরাধ কমবে।
- শিক্ষার্থীরা খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে বেশি যুক্ত হবে।
নেতিবাচক দিক
- অনলাইন ক্লাস বা ডিজিটাল শিক্ষা কার্যক্রমে সীমাবদ্ধতা আসতে পারে।
- শিক্ষামূলক কন্টেন্ট থেকে বঞ্চিত হওয়ার আশঙ্কা।
- অভিভাবকরা সন্তানের সঙ্গে জরুরি সময়ে যোগাযোগ করতে পারবেন না।
সভার অন্যান্য আলোচ্য বিষয়
মোবাইল নিষিদ্ধ ছাড়াও সভায় আরও কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়—
- টানা বৃষ্টিতে ক্ষতিগ্রস্ত সড়ক দ্রুত সংস্কার।
- মৌসুমী সারের সংকট মোকাবিলায় কার্যকর উদ্যোগ।
- বাল্যবিবাহ ও ইভটিজিং প্রতিরোধে কঠোর ব্যবস্থা।
- আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসনের সমন্বয় জোরদার।
সভায় ইউএনও মো. আল আমীনের সভাপতিত্বে উপস্থিত ছিলেন উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) সৈয়দজাদী মাহবুবা মঞ্জুর মৌনা, থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মামুন হোসেন বিশ্বাস, উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আলমগীর হোসেন, উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা জুয়েল শেখ, বিজিবি প্রতিনিধি, রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ ও স্থানীয় সাংবাদিকরা।
চুয়াডাঙ্গার জীবননগরে স্কুল-কলেজে মোবাইল নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত শিক্ষা খাতের জন্য একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ হতে পারে। তবে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, শুধু নিষিদ্ধ নয়, পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের প্রযুক্তি ব্যবহারের সঠিক দিকও শেখাতে হবে।
এখন দেখার বিষয়, এই সিদ্ধান্ত বাস্তবে কতটা কার্যকর হয় এবং দেশের অন্য জেলায় একই ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হয় কি না।
MAH – 12412 , Signalbd.com