ওড়িশায় শিক্ষকের কুপ্রস্তাব ও হুমকি, নিজের গায়ে আগুন দিলেন কলেজছাত্রী

ভারতের ওড়িশা রাজ্যের বালাসোর জেলার এক কলেজে বিভাগীয় প্রধানের বিরুদ্ধে অনৈতিক প্রস্তাব ও ভবিষ্যৎ ধ্বংসের হুমকি দেওয়ার অভিযোগে তোলপাড়। প্রতিবাদে নিজের শরীরে আগুন ধরিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন এক কলেজছাত্রী। ঘটনায় ৯৫% দগ্ধ ছাত্রীসহ আহত হয়েছেন আরও একজন। অভিযুক্ত শিক্ষককে গ্রেফতার করা হয়েছে, সাময়িক বরখাস্ত কলেজ অধ্যক্ষও।
অভিযোগ থেকে আত্মাহুতি
ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য ওড়িশার বালাসোরে ভয়াবহ এক ঘটনা রীতিমতো নাড়িয়ে দিয়েছে স্থানীয় প্রশাসন ও শিক্ষাক্ষেত্রকে। ফকির মোহন কলেজে অধ্যয়নরত ইন্টিগ্রেটেড বি.এড প্রোগ্রামের এক ছাত্রী অভিযোগ করেন, তার বিভাগীয় প্রধান সমীর কুমার সাহু তাকে অনৈতিক প্রস্তাব দেন। ওই প্রস্তাব না মানলে তাকে একাডেমিকভাবে ধ্বংস করে দেওয়ার হুমকিও দেন তিনি।
অভিযোগ জানানোর কয়েকদিন পেরিয়ে গেলেও কোনো দৃশ্যমান পদক্ষেপ না আসায় শনিবার (১২ জুলাই) ওই ছাত্রী কলেজ চত্বরে নিজের শরীরে আগুন ধরিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন।
অভিযোগের বিবরণ ও প্রশাসনিক নিষ্ক্রিয়তা
ভুক্তভোগী ছাত্রী গত ১ জুলাই কলেজের অভ্যন্তরীণ অভিযোগ কমিটিতে লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন। অভিযোগে উল্লেখ ছিল, সমীর সাহু বারবার তাকে নৈতিকতার সীমা লঙ্ঘন করতে বলেন এবং প্রত্যাখ্যান করলে পরীক্ষায় ফেল করানোসহ বিভিন্ন ভয় দেখান।
কলেজ কর্তৃপক্ষ প্রাথমিকভাবে আশ্বাস দিলেও বাস্তবিক কোনো পদক্ষেপ না নেওয়ায় শিক্ষার্থীরা ক্ষুব্ধ হন। ঘটনার দিন কলেজের মূল গেটের সামনে শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভে অংশ নেয়। তখনই অভিযুক্ত শিক্ষককে সাময়িক বরখাস্তের দাবি ওঠে।
আগুন লাগানোর মুহূর্ত ও আহতদের অবস্থা
বিক্ষোভ চলাকালীন ছাত্রীটি আচমকা অধ্যক্ষের অফিস সংলগ্ন এলাকায় গিয়ে পেট্রোল ঢেলে নিজের গায়ে আগুন ধরিয়ে দেন। আশপাশের শিক্ষার্থীরা দ্রুত ছুটে গিয়ে আগুন নেভানোর চেষ্টা করেন।
সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায়, আগুন লাগার পর ছাত্রীর দেহ থেকে ধোঁয়া বের হতে থাকে এবং তিনি একটি করিডোরের দিকে ছুটে যান। এ সময় এক সহপাঠী তাকে বাঁচাতে গিয়ে নিজেও মারাত্মকভাবে দগ্ধ হন।
বর্তমানে দুইজনকেই আশঙ্কাজনক অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। ছাত্রীটির শরীরের ৯৫ শতাংশ ও সহপাঠীর ৭০ শতাংশ পুড়ে গেছে বলে চিকিৎসকরা জানিয়েছেন।
প্রশাসনের তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ ও প্রতিক্রিয়া
ওড়িশার উচ্চশিক্ষা মন্ত্রী সূর্যবংশী সুরজ এক বিবৃতিতে বলেন, “অভিযুক্ত শিক্ষককে গ্রেফতার করা হয়েছে। পাশাপাশি কলেজ অধ্যক্ষকেও সাময়িক বরখাস্ত করে তদন্ত শুরু হয়েছে।”
বালাসোরের পুলিশ সুপার রাজ প্রসাদ জানান, ঘটনার তদন্তে একাধিক দল কাজ করছে এবং অপরাধ প্রমাণিত হলে অভিযুক্তের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করা হবে।
কলেজ কর্তৃপক্ষের বক্তব্য
কলেজের অধ্যক্ষ দিলীপ ঘোষ বলেন, “ছাত্রীটির অভিযোগ আমরা গ্রহণ করেছি এবং তদন্তের একটি খসড়া প্রক্রিয়াধীন ছিল। ঘটনার দিন সে আমার অফিসে এসেছিল এবং মারাত্মক মানসিক চাপে থাকার কথা জানায়। সে চায় অভিযুক্ত শিক্ষককে অফিসে ডাকা হোক, যা আমি করেছি। উভয় পক্ষকেই বলেছিলাম, মিথ্যা প্রমাণিত হলে পরিণতি কী হতে পারে।”
তবে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ায় শিক্ষার্থীদের মধ্যে অসন্তোষ আরও বাড়তে থাকে।
নারী নির্যাতন ও শিক্ষাক্ষেত্রে অনৈতিকতার বিরুদ্ধে প্রশ্ন
এই ঘটনার মাধ্যমে আবারও সামনে এসেছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ক্ষমতার অপব্যবহার ও নারী শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার প্রশ্ন। বিশেষ করে শিক্ষকদের নৈতিক বিচ্যুতি কতোটা ভয়ঙ্কর হতে পারে, তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল এই ঘটনা।
মানসিকভাবে বিপর্যস্ত ছাত্রীটি বারবার অভিযোগ জানানো সত্ত্বেও প্রশাসনের ধীর প্রতিক্রিয়া প্রশ্নবিদ্ধ করেছে পুরো ব্যবস্থাপনাকে।
ভবিষ্যতের করণীয় ও উদ্বেগ
বিশেষজ্ঞদের মতে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে স্বচ্ছ এবং দ্রুত অভিযোগ নিষ্পত্তির জন্য কার্যকর ও নিরপেক্ষ কমিটি থাকা জরুরি। শুধু অভিযুক্তকে শাস্তি দিলেই সমাধান নয়, শিক্ষার্থীদের মাঝে আস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য প্রশাসনকে আরও দায়িত্বশীল হতে হবে।
“শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যেন নিরাপদ আশ্রয় হয়, ভয় বা হুমকির জায়গা নয়” — শিক্ষাবিদ অনিরুদ্ধ মিশ্র
সারসংক্ষেপ
ওড়িশার এই ঘটনা কেবল একজন ছাত্রীর মানসিক ও শারীরিক যন্ত্রণা নয়, বরং গোটা শিক্ষা ব্যবস্থার দিকে তীব্র প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছে। শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এবং অনৈতিক শিক্ষকদের বিরুদ্ধে কঠোর নজরদারি চালানো ছাড়া ভবিষ্যতে এমন ঘটনা আরও ঘটতে পারে।
তবে প্রশ্ন থেকেই যায়— শিক্ষাঙ্গন কি আদৌ সবার জন্য নিরাপদ?
এম আর এম – ০৩০৬, Signalbd.com