আবহাওয়া

নিম্নচাপের তাণ্ডবে উত্তাল বঙ্গোপসাগর, ১৫ জেলায় জলোচ্ছ্বাস

বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় নতুন করে সতর্কতার ঘণ্টা বেজে উঠেছে। বঙ্গোপসাগরে গড়ে ওঠা নিম্নচাপের কারণে সমুদ্র আবারো উত্তাল, যা দেশের ১৫টি উপকূলীয় জেলায় ১ থেকে ৩ ফুট পর্যন্ত উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসের সম্ভাবনা তৈরি করেছে। আবহাওয়া অধিদফতর থেকে জরুরি সতর্কতা জারি করা হয়েছে এবং সমুদ্রবন্দরগুলোকে তিন নম্বর স্থানীয় সতর্ক সংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে।

বঙ্গোপসাগরে নিম্নচাপ, সাগর উত্তাল

আবহাওয়া অধিদফতরের আজকের (২৬ জুলাই) বিশেষ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, পশ্চিমবঙ্গ ও ঝাড়খণ্ড সীমান্তবর্তী এলাকায় অবস্থানরত নিম্নচাপটি পশ্চিম-উত্তরপশ্চিম দিকে অগ্রসর হচ্ছে। এর প্রভাবে উত্তর বঙ্গোপসাগরে বায়ুচাপের পার্থক্য বেড়ে যাওয়ায় ঝড়ো হাওয়া সৃষ্টি হচ্ছে এবং সমুদ্র উত্তাল হচ্ছে। ফলে সমুদ্রবন্দরে তিন নম্বর সতর্ক সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে। এতে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, মোংলা ও পায়রা বন্দরের সঙ্গে ১৫টি উপকূলীয় জেলায় জলোচ্ছ্বাসের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

কোন জেলাগুলো বিপদে?

আবহাওয়া অধিদফতরের পূর্বাভাস অনুযায়ী নিম্নলিখিত জেলাগুলো জলোচ্ছ্বাসের ঝুঁকিতে রয়েছে:

  • সাতক্ষীরা
  • খুলনা
  • বাগেরহাট
  • ঝালকাঠি
  • পিরোজপুর
  • বরিশাল
  • বরগুনা
  • পটুয়াখালী
  • ভোলা
  • চাঁদপুর
  • লক্ষ্মীপুর
  • নোয়াখালী
  • ফেনী
  • চট্টগ্রাম
  • কক্সবাজার

উল্লেখ্য, এই অঞ্চলের দ্বীপ ও চরাঞ্চলগুলোতেও ১ থেকে ৩ ফুট উচ্চতার বায়ুতাড়িত জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল।

কেন এই জলোচ্ছ্বাস?

আবহাওয়া অধিদফতর জানাচ্ছে, অমাবস্যার সময় এবং নিম্নচাপের সম্মিলিত প্রভাবেই এই জলোচ্ছ্বাস তৈরি হচ্ছে। সমুদ্রের পানি একদিকে জলোচ্ছ্বাসের মাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে, অন্যদিকে ঝড়ো হাওয়া ও প্রবল ঢেউ উপকূলের চর ও নিম্নাঞ্চলগুলোকে দ্রুত প্লাবিত করছে। বিশেষ করে নদীমুখের কাছাকাছি ও নিচু এলাকাগুলোতে পানি প্রবেশ করে ব্যাপক ক্ষতি হতে পারে।

সমুদ্রবন্দরে সতর্কতা

চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, মোংলা ও পায়রা সমুদ্রবন্দরকে তিন নম্বর স্থানীয় সতর্ক সংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে, যা সবচেয়ে উচ্চ সতর্কতার স্তর। এসব বন্দরে নৌকা ও ট্রলারগুলোকে নিরাপদ আশ্রয়ে থাকার জন্য অনুরোধ জানানো হয়েছে এবং পরবর্তী নির্দেশনা না আসা পর্যন্ত মাছ ধরার সকল কার্যক্রম বন্ধ রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা ও প্রভাব

  • নোয়াখালী: রাতভর থেমে থেমে বৃষ্টির ফলে হাতিয়ার উপজেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। জেলা সদরসহ বিভিন্ন এলাকার জলাবদ্ধতা তীব্র হয়েছে।
  • কক্সবাজারের টেকনাফ: সমুদ্রের ঢেউয়ের কারণে মেরিন ড্রাইভের আড়াই কিলোমিটার এলাকায় ভাঙন ধরেছে। ভাঙা বাঁধ দিয়ে পানি ঢুকে প্লাবিত হয়েছে কুতুবদিয়ার আনিসের ডেইল, তাবলর চর, বায়ু বিদ্যুৎ কেন্দ্রের আশপাশের রাস্তা-ঘাট।
  • মহেশখালী: ধলঘাটা ও মাতারবাড়ির নিম্নাঞ্চলে ঢুকেছে পানি।
  • পটুয়াখালী: কুয়াকাটায় ঢেউয়ের তোড়ে মেরিন ড্রাইভের বেশ কিছু অংশ ভেঙে গেছে।

মাছ ধরার নৌকা ও ট্রলারগুলোর জন্য সতর্কবার্তা

আবহাওয়া অধিদফতর থেকে বিশেষভাবে বলা হয়েছে, নিম্নচাপ ও জলোচ্ছ্বাসের কারণে সকল মাছ ধরার নৌকা ও ট্রলার যেন নিরাপদ আশ্রয়ে থাকে এবং তাদেরকে ঝড় শুরুর আগে নিরাপদ স্থানগুলোতে স্থানান্তর করতে হবে। ঝড়ো হাওয়া ও জলোচ্ছ্বাসের কারণে সমুদ্রযাত্রা অত্যন্ত বিপজ্জনক হয়ে উঠবে, তাই এ ব্যাপারে সাবধানতা অপরিহার্য।

জলোচ্ছ্বাস ও নিম্নচাপ: বাংলাদেশের উপকূলীয় ঝুঁকি

বাংলাদেশে বর্ষাকাল ও গ্রীষ্মকালীন মরসুমে বঙ্গোপসাগরে নিম্নচাপ তৈরি হয়ে থাকে। এই নিম্নচাপগুলো সমুদ্রের উত্তাল ঢেউ ও বায়ুর পরিমাণ বৃদ্ধি করে উপকূলীয় অঞ্চলে প্রাকৃতিক দুর্যোগের সৃষ্টি করে। সাগরের জলোচ্ছ্বাসের সঙ্গে সমুদ্রবন্দরে ঝড়ো হাওয়ার প্রভাবে মাছ ধরার নৌকা ও ট্রলার চলাচল বিপজ্জনক হয়ে পড়ে। নিম্নচাপের সময় বাংলাদেশে সাগর উত্তাল হওয়া, বায়ুর তীব্রতা বৃদ্ধি পাওয়া এবং বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়া স্বাভাবিক।

জলোচ্ছাষের কারণে উপকূলীয় জেলা ও চরাঞ্চলগুলো প্লাবিত হয়, যা ফসল ও বসতবাড়ির ব্যাপক ক্ষতি করে। এছাড়াও নদীপথে চলাচলও প্রভাবিত হয়, ফলে ব্যবসা-বাণিজ্য ও যোগাযোগে বিঘ্ন ঘটে। বিশেষ করে নিম্নাঞ্চল ও চরাঞ্চলের মানুষের জীবনযাত্রা কঠিন হয়ে পড়ে।

প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় প্রস্তুতি ও সতর্কতা

সরকারি বিভিন্ন সংস্থা, বিশেষত আবহাওয়া অধিদফতর ও জাতীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সংস্থা, এসব ঝুঁকি কমাতে সতর্কতা জারি করে থাকে। জলোচ্ছ্বাস ও নিম্নচাপের খবর সময়মতো প্রেরণ, উপকূলীয় এলাকায় দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ ও প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করা এ প্রক্রিয়ার অংশ। স্থানীয় প্রশাসন, পোলিকল ও স্বেচ্ছাসেবক দল প্লাবিত এলাকায় উদ্ধার কার্যক্রম ও ত্রাণ কার্যক্রম চালায়।

এ ছাড়া, মেরিন ড্রাইভ ও সমুদ্রতীরবর্তী বাঁধ, বাঁধ ভাঙ্গা স্থানগুলো মেরামত করা ও পুনর্গঠন করার জন্য কাজ চলমান থাকে। স্থানীয় জনগণকেও অতি সতর্ক থাকার জন্য সচেতন করা হয় এবং ঝড় ও জলোচ্ছাষ শুরু হওয়ার আগেই নিরাপদ স্থানে চলে যেতে বলা হয়।

বর্তমান নিম্নচাপের প্রভাবে বঙ্গোপসাগর উত্তাল এবং বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় জলোচ্ছ্বাসের সম্ভাবনা বেড়েছে। আবহাওয়া অধিদফতরের জরুরি সতর্কবার্তা অনুসরণ করে সকলের উচিত সতর্ক থাকা এবং প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি গ্রহণ করা। মাছ ধরার নৌকা ও ট্রলার মালিকদের দ্রুত নিরাপদ আশ্রয়ে যাওয়ার নির্দেশ মেনে চলা অত্যন্ত জরুরি।

প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় দেশের সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে, যাতে কম ক্ষতি হয় এবং দ্রুত স্বাভাবিক জীবন ফিরে আসে।

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Advertisement
Back to top button