ছেলের লাশ দেখে বাবার বিলাপ: ভ্যান নিবি নে, ছোয়ালকে মারলি ক্যান?

কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার জগন্নাথপুর ইউনিয়নের পদ্মা নদীর পাড় থেকে সোমবার (১৮ আগস্ট) সকালে উদ্ধার হলো কিশোর ভ্যানচালক হৃদয় আলীর (১৫) গলাকাটা মরদেহ। স্থানীয়রা একটি কলাবাগানে কাজ করতে গিয়ে লাশ দেখতে পান। পরে পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে মরদেহ উদ্ধার করে কুষ্টিয়া সদর হাসপাতালের মর্গে পাঠায়।
হৃদয়ের মৃত্যুতে পরিবার ও এলাকাজুড়ে নেমে এসেছে শোকের ছায়া। বিশেষ করে বাবার কান্নাজড়িত বিলাপ — “তুরা ভ্যান নিবি নে, আমার ছোয়ালকে মারলি ক্যান?” — শুনে উপস্থিত সবাই আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন।
ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার মরদেহ
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, সোমবার সকাল সাড়ে ১১টার দিকে উপজেলার হাসিমপুর পদ্মা নদীর পাড়ের একটি বাগানে ঘাস কাটতে গিয়ে কৃষকেরা হৃদয়ের মরদেহ দেখতে পান। খবর পেয়ে গ্রাম পুলিশ ও কুমারখালী থানা পুলিশ সেখানে পৌঁছে মরদেহ উদ্ধার করে।
হৃদয়ের গলা গভীরভাবে কাটা ছিল। শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়। ঘটনাস্থলের আশপাশে রক্তের দাগ ছাড়াও লড়াইয়ের চিহ্ন লক্ষ্য করা গেছে।
নিহত হৃদয় ও তার পরিবারের পরিচয়
নিহত হৃদয় আলী কুমারখালী পৌরসভার ৩ নম্বর ওয়ার্ডের এলংগী এলাকার বাসিন্দা ভ্যানচালক ইউনুস শেখের ছেলে। দরিদ্র পরিবারে জন্ম নেওয়া হৃদয় পড়াশোনার পাশাপাশি সংসারের বোঝা ভাগ করে নিতে অল্প বয়সেই ভ্যান চালানো শুরু করে।
পরিবারের অভিযোগ, ভ্যান ছিনতাইয়ের উদ্দেশ্যে তাকে হত্যা করা হয়েছে।
নিখোঁজ হওয়ার পর ঘটনার মোড়
রোববার (১৭ আগস্ট) বিকেলে বাড়ি থেকে ভ্যান নিয়ে বের হয়েছিল হৃদয়। রাতে সে আর বাড়ি ফেরেনি। অনেক খোঁজাখুঁজি করেও তাকে পাওয়া যায়নি।
পরের দিন সকালে পরিবারের পক্ষ থেকে কুমারখালী থানায় অভিযোগ করা হয়। অভিযোগের কয়েক ঘণ্টা পর স্থানীয়দের মাধ্যমে খবর পেয়ে পুলিশ পদ্মার চর থেকে তার গলাকাটা মরদেহ উদ্ধার করে।
বাবার বুকফাটা আহাজারি
ছেলের মৃত্যুতে শোকে পাথর হয়ে যান বাবা ইউনুস শেখ। থানার সামনে দাঁড়িয়ে তিনি কাঁদতে কাঁদতে বলেন, “তুরা ভ্যান নিবি নে, আমার ছোয়ালকে মারলি ক্যান? ভ্যানের জন্য আমার ছেলেকে মেরে ফেলল।”
তিনি আরও বলেন, “আমি থানায় মামলা করব। আসামিদের দ্রুত গ্রেপ্তার করে ফাঁসি দিতে হবে। নইলে এভাবে গরিবের ছেলেরা একের পর এক খুন হবে।”
স্বজনদের বক্তব্য
নিহত হৃদয়ের চাচা ফিরোজ শেখ বলেন, “ভাতিজা রোববার বিকেলে ভ্যান নিয়ে বের হয়েছিল। তারপর আর ফেরেনি। খোঁজাখুঁজির পর আজ সকালে খবর পেয়ে পদ্মার চর থেকে তার গলাকাটা মরদেহ উদ্ধার করা হয়।”
স্বজনদের দাবি, হৃদয়কে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করে ভ্যান নিয়ে গেছে দুর্বৃত্তরা।
স্থানীয়দের প্রতিক্রিয়া
স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, এ ধরনের হত্যাকাণ্ড দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে। নদীর চরাঞ্চলে ছিনতাইকারীরা সক্রিয় হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে কিশোর ভ্যানচালক ও দিনমজুরদের টার্গেট করছে তারা।
গ্রাম পুলিশ নিমাই ঘোষ বলেন, “স্থানীয় লোকজন ঘাস কাটতে গিয়ে লাশ দেখে আমাকে খবর দেন। আমি দ্রুত ঘটনাস্থলে গিয়ে ছবি তুলে থানায় খবর দিই।”
পুলিশের অবস্থান
কুমারখালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আমিরুল ইসলাম বলেন, “নিখোঁজ হওয়ার একদিন পর খবর পেয়ে পুলিশ হৃদয় আলীর গলাকাটা মরদেহ উদ্ধার করেছে। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, ভ্যান ছিনিয়ে নিতে তাকে হত্যা করা হয়েছে। মরদেহ ময়নাতদন্তের জন্য কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয়েছে। এ ঘটনায় মামলা প্রক্রিয়াধীন।”
এলাকায় অপরাধ প্রবণতা
স্থানীয়দের ভাষ্য, গত কয়েক বছরে কুমারখালীর বিভিন্ন গ্রামে ভ্যান ও অটোরিকশা ছিনতাইয়ের ঘটনা বেড়েছে। অনেক ক্ষেত্রেই এসব ঘটনায় চালকদের ওপর হামলা হয়েছে, এমনকি খুনও করা হয়েছে।
তাদের দাবি, এসব অপরাধীদের দ্রুত গ্রেপ্তার না করলে আরও নিরীহ মানুষের প্রাণহানি ঘটবে।
ঘটনার প্রভাব ও শঙ্কা
এই হত্যাকাণ্ডে পুরো এলাকায় আতঙ্ক বিরাজ করছে। অভিভাবকরা এখন আর সহজে তাদের সন্তানদের একা বাইরে কাজে পাঠাতে চাইছেন না।
মানবাধিকারকর্মীরা মনে করছেন, এ ধরনের ঘটনায় দরিদ্র পরিবারের শিশুরা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির মুখে পড়ে। দ্রুত অপরাধীদের আইনের আওতায় না আনলে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ রূপ নিতে পারে।
সারসংক্ষেপ
কুষ্টিয়ার কুমারখালীতে ১৫ বছরের কিশোর ভ্যানচালক হৃদয় আলীর গলাকাটা লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। ভ্যান ছিনতাইয়ের উদ্দেশ্যে তাকে হত্যা করা হয়েছে বলে অভিযোগ স্বজনদের। ছেলের লাশ দেখে শোকে ভেঙে পড়েন বাবা ইউনুস শেখ।
কিশোর ভ্যানচালক হৃদয় আলীর মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ড স্থানীয় জনমনে গভীর ক্ষোভ সৃষ্টি করেছে। পরিবার শোকে ভেঙে পড়লেও এখন তাদের একটাই দাবি—দ্রুত বিচার।
এখন প্রশ্ন হলো, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কত দ্রুত হত্যাকারীদের শনাক্ত ও গ্রেপ্তার করতে পারে, সেটিই সবার নজরে।
এম আর এম – ০৯১৮, Signalbd.com