হামাস আত্মসমর্পণ করছে না প্রশ্ন উঠছে নেতানিয়াহুকে

মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম দীর্ঘমেয়াদি এবং রক্তক্ষয়ী সংঘাতের কেন্দ্রে থাকা গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলি হামলা অব্যাহত রয়েছে। কিন্তু এর মধ্যেও হামাস নামক ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ গোষ্ঠী এখনো আত্মসমর্পণ করেনি। কেন তারা এখনো লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে? ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর যুদ্ধকেন্দ্রিক কৌশল কি এই সংঘাতের শান্তিপূর্ণ সমাধানে সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে?
মিডল ইস্ট আইয়ের প্রধান সম্পাদক ডেভিড হার্স্ট এক বিশ্লেষণধর্মী লেখায় বিষয়টি বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করেছেন।
হামাস আত্মসমর্পণ করছে না—কারণ কী?
গাজার সাধারণ মানুষ এবং হামাস প্রতিদিন যে দুঃসহ পরিস্থিতির মুখোমুখি হচ্ছে, তাতে আত্মসমর্পণ না করার পেছনে অনেক বাস্তব এবং মনস্তাত্ত্বিক কারণ রয়েছে। একদিকে গাজায় প্রতিদিনই বোমা বর্ষণ, খাদ্য ও পানি সংকট এবং বেসামরিক অবকাঠামোর ধ্বংস, অন্যদিকে রয়েছে জাতিগত অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই।
হামাস মনে করে, এই সংঘর্ষে তারা তাদের কৌশলগত লক্ষ্য অর্জনের পথে আছে—বিশ্বব্যাপী ফিলিস্তিনি আত্মনিয়ন্ত্রণ ও স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষাকে পুনরায় আলোচনার কেন্দ্রে নিয়ে আসা।
ইসরায়েলের প্রস্তাব: আসলে একরকম আত্মসমর্পণ
সম্প্রতি ইসরায়েল একটি প্রস্তাব দেয় যাতে বলা হয়, ৪৫ দিনের খাদ্য ও পানি সরবরাহের বিনিময়ে হামাস যেন সব ইসরায়েলি জিম্মিকে মুক্তি দেয় এবং নিরস্ত্র হয়। তবে হামাস তার পরিবর্তে দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব দেয় এবং গাজার প্রশাসন অন্য ফিলিস্তিনি গোষ্ঠীর হাতে হস্তান্তরের কথা জানায়, যদিও তারা নিরস্ত্র হতে রাজি হয়নি এবং ইসরায়েলি বাহিনীর গাজা ত্যাগের দাবিতে অনড় থাকে।
নেতানিয়াহুর দ্বিচারিতা ও যুদ্ধ দীর্ঘায়নের রাজনীতি
বিশ্লেষক ডেভিড হার্স্ট বলছেন, শান্তিপূর্ণ সমাধানের পথে সবচেয়ে বড় বাধা নেতানিয়াহু নিজেই। তিনি একাধিকবার হামাসের সঙ্গে চুক্তি করলেও শেষ পর্যন্ত নিজেই তা ভঙ্গ করেন। এমনকি মার্কিন প্রেসিডেন্টদের দূতদের মধ্যস্থতা চেষ্টাও তিনি ব্যর্থ করে দেন।
তার প্রধান লক্ষ্য রাজনৈতিক ক্ষমতা রক্ষা, যেকোনো মূল্যে। এমনকি কট্টর ডানপন্থীদের সমর্থন ধরে রাখার জন্য তিনি যুদ্ধকে টেনে নিয়ে চলেছেন।
গাজার ধ্বংস, কিন্তু আত্মার অবিনাশ
যদিও হামাসের সামরিক এবং রাজনৈতিক কাঠামো ইসরায়েলি হামলায় ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তারপরও তারা নির্বাসন বা মোটা অর্থের বিনিময়ে দেশ ত্যাগের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে। ফিলিস্তিনি জনগণের চেতনায় গাজা এখন একটি প্রতিরোধের প্রতীক। প্রতিটি পরিবার হারিয়েছে আপনজন, ঘরবাড়ি। এই রক্তক্ষয়ী অভিজ্ঞতা তাদের আত্মমর্যাদার লড়াইকে আরও দৃঢ় করে তুলেছে।
আন্তর্জাতিক জনমতেও পরিবর্তন
ডেভিড হার্স্টের মতে, হামাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ সত্ত্বেও বিশ্বব্যাপী জনমত ইসরায়েলের বিপক্ষে যাচ্ছে। পিউ রিসার্চের সাম্প্রতিক জরিপে দেখা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রে এখন ৫৩ শতাংশ মানুষ ইসরায়েল সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা পোষণ করে, যা ৭ অক্টোবরের আগের তুলনায় ৯ শতাংশ বেশি।
আইন হয়তো হামাসকে সন্ত্রাসী ঘোষণা করেছে, কিন্তু মানুষের মনোজগতে তারা একটি প্রতিরোধ প্রতীকে পরিণত হচ্ছে।
কী হতে পারে পরবর্তী ধাপ?
ডেভিড হার্স্ট আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন, যদি ইরানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের আলোচনায় অগ্রগতি না হয়, তাহলে নেতানিয়াহু গোপনে বা প্রকাশ্যে ইরানে হামলার চেষ্টা করতে পারেন। তখন গাজার জন্য কোনো কূটনৈতিক সমাধান সম্ভব হবে না।
অন্যদিকে, হামাস জানে, তাদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হলেও, তারা এক ঐতিহাসিক ও আদর্শিক সংগ্রামে বিজয়ের পথে রয়েছে।
হামাস কেন আত্মসমর্পণ করবে না—এই প্রশ্নের উত্তর শুধু তাদের আদর্শিক দৃঢ়তা নয়, বরং ইসরায়েলের রাজনৈতিক নেতৃত্বের কৌশলগত সংকীর্ণতাতেও নিহিত। যুদ্ধ থামানোর চাবিকাঠি হয়তো হামাসের হাতে নেই, কিন্তু গাজার মানুষের অবিচল চেতনায় রয়েছে এক নতুন ইতিহাস লেখার ইচ্ছা।