কলকাতায় দোল উৎসবে ডেকে এনে তৃণমূলের ছাত্রনেতাকে হত্যা

পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ২৪ পরগনার খড়দহে দোল উৎসবের দিন তৃণমূল ছাত্র পরিষদের এক ছাত্রনেতাকে নির্মমভাবে হত্যা করার অভিযোগ উঠেছে। নিহত ছাত্রনেতার নাম অমর চৌধুরী, যিনি তৃণমূল ছাত্র পরিষদের সক্রিয় সদস্য ছিলেন। হত্যার ঘটনায় মূল অভিযুক্ত হিসেবে পবন রাজভর নামের এক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। তবে হত্যাকাণ্ডে আরও কয়েকজন জড়িত থাকার সন্দেহে তাদের গ্রেপ্তারে অভিযান চালাচ্ছে পুলিশ।
ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ
১৪ মার্চ শুক্রবার দুপুরে খড়দহে জয়শ্রী কেমিক্যালসের সামনে যখন দোল উৎসব উদযাপিত হচ্ছিল, তখনই এই নৃশংস ঘটনা ঘটে। প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, অমর চৌধুরীকে পরিকল্পিতভাবে দোল উৎসবে ডেকে আনা হয়েছিল। উৎসবের আনন্দের মধ্যেই একদল যুবক হঠাৎ তাঁর ওপর চড়াও হয় এবং তাঁকে মারধর করতে শুরু করে। একপর্যায়ে ধারালো ক্ষুর দিয়ে তাঁর ঘাড়ে আঘাত করা হয়। এতে তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন।
স্থানীয় বাসিন্দারা সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যান। প্রথমে তাঁকে স্থানীয় হাসপাতালে ভর্তি করা হলেও শারীরিক অবস্থার অবনতি হওয়ায় বিকেলে কলকাতার আরজি কর মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হয়। তবে চিকিৎসকেরা জানান, হাসপাতালে আনার আগেই তাঁর মৃত্যু হয়েছে।
পুলিশের তদন্ত ও গ্রেপ্তার
এই হত্যাকাণ্ডের পরপরই খড়দহ থানার পুলিশ তদন্ত শুরু করে। ঘটনাস্থলের সিসিটিভি ফুটেজ খতিয়ে দেখা হচ্ছে এবং প্রত্যক্ষদর্শীদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। পুলিশের প্রাথমিক তদন্তে উঠে এসেছে যে, পবন রাজভর সম্প্রতি কারাগার থেকে জামিনে মুক্তি পেয়েই এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। পুলিশ ইতিমধ্যেই পবন রাজভরকে গ্রেপ্তার করেছে এবং কানাইয়া নামে এক যুবকসহ আরও দুজনকে ধরতে তল্লাশি চালাচ্ছে।
পরিবারের অভিযোগ ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট
নিহত অমর চৌধুরীর পরিবারের দাবি, হত্যার পেছনে তিনজন ব্যক্তি জড়িত। তারা পূর্বপরিকল্পিতভাবে অমরকে হত্যা করেছে। পরিবারের সদস্যদের অভিযোগ, অমরের রাজনৈতিক পরিচয়ের কারণেই তাঁকে টার্গেট করা হয়েছিল।
স্থানীয় সূত্রের খবর অনুযায়ী, নিহত অমর চৌধুরী খড়দহের তৃণমূল কাউন্সিলর বিকাশ সিংহের ঘনিষ্ঠ ছিলেন। ফলে এই হত্যাকাণ্ড রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত কি না, তা নিয়েও আলোচনা চলছে। তবে পুলিশ এখনো হত্যার মূল উদ্দেশ্য সম্পর্কে নিশ্চিত কোনো তথ্য দেয়নি। পুলিশের প্রাথমিক ধারণা, ব্যক্তিগত বিরোধ বা পূর্বশত্রুতার কারণেই এই হত্যাকাণ্ড ঘটে থাকতে পারে।
সন্ত্রাসের নতুন ইঙ্গিত?
খড়দহ ও আশপাশের এলাকায় সাম্প্রতিক সময়ে একাধিক অপরাধমূলক ঘটনার খবর পাওয়া গেছে। বিশেষ করে রাজনৈতিক দলের অন্তর্দ্বন্দ্ব এবং এলাকায় প্রভাব বিস্তারের চেষ্টার কারণে বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে উত্তেজনা বাড়ছে। অমর চৌধুরীর হত্যাকাণ্ড সেই উত্তেজনাকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে।
এই ঘটনার পর খড়দহ ও সংলগ্ন এলাকায় পুলিশি টহল বাড়ানো হয়েছে। স্থানীয়দের আশ্বস্ত করতে প্রশাসনের তরফ থেকে বলা হয়েছে, অপরাধীদের দ্রুত আইনের আওতায় আনা হবে।
প্রত্যক্ষদর্শীদের বক্তব্য
এই হত্যাকাণ্ডের প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ঘটনার দিন অমর চৌধুরী যখন দোল উৎসবে অংশ নিচ্ছিলেন, তখন একদল যুবক মোটরসাইকেলে এসে তাঁকে ঘিরে ধরে। কিছু সময় কথাকাটাকাটির পর তাঁকে মারধর করা হয় এবং শেষে ধারালো অস্ত্র দিয়ে হত্যা করা হয়। স্থানীয় বাসিন্দারা বলেন, “আমরা কখনো ভাবিনি, উৎসবের দিন এভাবে কাউকে হত্যা করা হবে। পুলিশকে আমরা অনুরোধ করছি, দোষীদের দ্রুত গ্রেপ্তার করে শাস্তি দেওয়া হোক।”
রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া
এই হত্যাকাণ্ড নিয়ে ইতোমধ্যেই রাজনৈতিক অঙ্গনে উত্তেজনা ছড়িয়েছে। তৃণমূল কংগ্রেসের নেতারা এই ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়ে দোষীদের দ্রুত গ্রেপ্তারের দাবি তুলেছেন। তৃণমূলের স্থানীয় বিধায়ক বলেন, “আমরা চাই, এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত সবাইকে কঠোর শাস্তির আওতায় আনা হোক। দোল উৎসবের দিন এমন নির্মম হত্যাকাণ্ড কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না।”
অন্যদিকে, বিজেপি নেতারা এই হত্যাকাণ্ডের জন্য রাজ্যের আইনশৃঙ্খলার অবনতি এবং তৃণমূলের অভ্যন্তরীণ কোন্দলকেই দায়ী করছেন। তাঁদের অভিযোগ, “এই হত্যাকাণ্ড প্রমাণ করে যে, পশ্চিমবঙ্গে আইনশৃঙ্খলা ভেঙে পড়েছে। প্রশাসন ব্যর্থ, আর অপরাধীরা লাগামছাড়া।”
সামাজিক প্রতিক্রিয়া
এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় সাধারণ মানুষের মধ্যেও আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। দোল উৎসবের দিন এভাবে প্রকাশ্যে হত্যা অনেককেই হতবাক করেছে। খড়দহের স্থানীয় বাসিন্দাদের অনেকে জানিয়েছেন, সাম্প্রতিক সময়ে এলাকায় অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড বৃদ্ধি পেয়েছে এবং প্রশাসনের আরও কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।
ময়নাতদন্ত ও পরবর্তী পদক্ষেপ
অমর চৌধুরীর মরদেহ ময়নাতদন্তের জন্য পাঠানো হয়েছে। ময়নাতদন্তের রিপোর্টের পরেই মৃত্যুর প্রকৃত কারণ জানা যাবে এবং এটি পূর্বপরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড কি না, তা বোঝা যাবে।
পুলিশ জানিয়েছে, “আমরা পুরো ঘটনা খতিয়ে দেখছি। সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। যারা এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত, তাদের দ্রুত গ্রেপ্তার করা হবে।”
উপসংহার
খড়দহে দোল উৎসবের দিন তৃণমূল ছাত্র পরিষদের নেতা অমর চৌধুরীর হত্যা শুধু একটি ব্যক্তিগত দ্বন্দ্বের ঘটনা নাকি রাজনৈতিক প্রতিহিংসার বহিঃপ্রকাশ, তা তদন্তসাপেক্ষ। তবে এই হত্যাকাণ্ড গোটা এলাকায় উত্তেজনা ছড়িয়ে দিয়েছে এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। প্রশাসনের কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া এখন সময়ের দাবি।