শিল্পে গ্যাস সংকট, করপোরেট কর কমানোর দাবি ব্যবসায়ীদের

দেশের শিল্প ও ব্যবসায়িক খাতে দীর্ঘদিন ধরেই চলছে এক ধরনের অচলাবস্থা। পর্যাপ্ত গ্যাসের ঘাটতি, ঋণের উচ্চ সুদের হার, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা এবং আমদানি-রপ্তানিতে নানা ধরনের জটিলতা মিলিয়ে উদ্যোক্তারা পড়েছেন তীব্র চাপে। এই প্রেক্ষাপটে ব্যবসা-বাণিজ্যে গতি আনতে আসন্ন ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে করপোরেট করের হার কমানোর জোর দাবি জানাচ্ছেন ব্যবসায়ীরা।
তবে, সরকারের নীতিনির্ধারকরা ইঙ্গিত দিয়েছেন—শর্ত কিছুটা শিথিল হলেও করপোরেট কর হার কমানোর সম্ভাবনা খুবই সীমিত। তারা বলছেন, অবকাঠামো উন্নয়নে পর্যাপ্ত রাজস্ব প্রয়োজন, যা কর আদায়ের বর্তমান কাঠামোর মাধ্যমেই সম্ভব।
শিল্পখাতে গ্যাস সংকট: উৎপাদনে বাধা
দেশজুড়ে শিল্প খাতের অন্যতম বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে গ্যাস সরবরাহের ঘাটতি। বহু শিল্প এলাকায় প্রতিদিন ঘণ্টার পর ঘণ্টা গ্যাস থাকে না। বিশেষ করে, তৈরি পোশাক, সিরামিকস, কেমিক্যাল, প্লাস্টিক ও খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে।
শিল্পমালিকরা বলছেন, নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহ না থাকায় উৎপাদন সক্ষমতা কমে এসেছে প্রায় ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত। এতে ব্যয় বেড়েছে, সময়মতো পণ্য সরবরাহে বিঘ্ন ঘটছে এবং আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতা হারাচ্ছে দেশি প্রতিষ্ঠানগুলো।
একজন শিল্প উদ্যোক্তা জানান, “গ্যাস সরবরাহ নির্ভরযোগ্য না হলে বিদেশি ক্রেতারা আস্থা হারাবে। আমরা সময়মতো পণ্য দিতে না পারলে তারা অন্য দেশ থেকে sourcing করবে।”
ব্যাংকঋণে চড়া সুদের হার: ব্যবসায়ীদের অতিরিক্ত চাপ
বর্তমানে ব্যাংক ঋণের সুদের হার ১২ থেকে ১৪ শতাংশের মধ্যে ওঠানামা করছে। এর ফলে নতুন বিনিয়োগের আগ্রহ কমছে, পুরাতন ঋণ পরিশোধে বাড়ছে ঝুঁকি। উদ্যোক্তাদের মতে, উচ্চ সুদে অর্থায়ন নিয়ে ব্যবসা পরিচালনা করা অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এফবিসিসিআইয়ের প্রশাসক হাফিজুর রহমান বলেন, “উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। একদিকে গ্যাস নেই, অন্যদিকে সুদের চাপ। আমরা যদি আন্তর্জাতিক বাজারে টিকতে চাই, তাহলে এই দুই ক্ষেত্রেই সরকারকে হস্তক্ষেপ করতে হবে।”
করপোরেট কর হার: উন্নয়ন নাকি প্রতিবন্ধকতা?
বর্তমানে বাংলাদেশের করপোরেট কর হার দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে অন্যতম উচ্চ। তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর জন্য শর্তসাপেক্ষে কর হার ২০ থেকে ২৫ শতাংশ, আর তালিকাভুক্ত নয় এমন প্রতিষ্ঠানের জন্য এ হার ২৭.৫ শতাংশ। আর্থিক খাতভুক্ত তালিকাভুক্ত নয় এমন প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে কর হার ৪০ শতাংশ পর্যন্ত।
ব্যবসায়ী নেতারা বলছেন, করপোরেট কর হার কমানো হলে বিদেশি বিনিয়োগ বাড়বে। কারণ, বিদেশি বিনিয়োগকারীরা প্রথমেই কর কাঠামোর দিকেই তাকান। এক্ষেত্রে কর হার যত বেশি, আকর্ষণ তত কম।
এফবিসিসিআইয়ের একজন পরিচালক বলেন, “বিশ্বের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে হলে কর কাঠামোকে আরও বিনিয়োগবান্ধব করতে হবে। ভারত ও ভিয়েতনামের কর হার তুলনামূলকভাবে কম, ফলে তারা বিনিয়োগ টানতে পারছে।”
সরকারের অবস্থান: রাজস্ব আদায়ই অগ্রাধিকার
অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ জানিয়েছেন, আগামী বাজেটে করপোরেট কর হার কমানোর কোনও পরিকল্পনা আপাতত নেই। বরং, অপ্রয়োজনীয় ওয়েভার বন্ধ করে কর কাঠামোকে সহজ ও শক্তিশালী করার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।
তিনি বলেন, “আমরা তো অনেক ওয়েভার বন্ধ করে দেবো। অনেক লো ক্যাটাগরি যারা পাচ্ছে তারা তো নিশ্চই খুশি হবে না। তবে বাজেটের মূল উদ্দেশ্য হবে রাজস্ব আয় বাড়ানো ও কাঠামোগত উন্নয়ন।”
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সদস্য আমিনুর রহমান বলেন, “বর্তমান পরিস্থিতিতে করপোরেট কর হার কমানোর মতো যুক্তি নেই। সরকারকে অবকাঠামো উন্নয়নে বড় অংকের অর্থ বিনিয়োগ করতে হবে। এর জন্য কর রাজস্ব বাড়ানো জরুরি।”
তিনি আরও যোগ করেন, “কর হার না কমিয়ে করজালের পরিধি বাড়ানো, ট্যাক্স ফাঁকি রোধ ও আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারই হওয়া উচিত সরকারের অগ্রাধিকার।”
বিনিয়োগে গতি আনতে স্থিতিশীলতা প্রয়োজন
ব্যবসায়ীরা শুধু কর ছাড় নয়, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করার আহ্বান জানিয়েছেন। কারণ, রাজনৈতিক অস্থিরতা ও হঠাৎ হঠাৎ নীতিমালার পরিবর্তন বিনিয়োগকারীদের আস্থা নষ্ট করে।
ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সভাপতি তাসকীন আহমেদ বলেন, “যৌক্তিক কারণ দেখিয়ে যদি কর কাঠামো সংস্কার করা হয় তাহলে সেটি রাজস্ব আদায়ের জন্যও ভালো হবে। তবে আমাদের সবার আগে দরকার স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশ।”
তিনি আরও বলেন, “শুধু করপোরেট কর নয়, এলসি খোলা, ডলার সংকট, আমদানি-রপ্তানির প্রক্রিয়ায় দীর্ঘসূত্রিতা—এসব মিলিয়েই উদ্যোক্তারা বাধার মুখে পড়ছেন।”
উপসংহার: ভারসাম্যপূর্ণ বাজেটই হতে পারে সমাধান
বর্তমান অর্থনৈতিক বাস্তবতায় একদিকে অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন পর্যাপ্ত রাজস্ব, অন্যদিকে বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে হলে করপোরেট কর হ্রাসের দাবি বিবেচনা করা জরুরি। তাই আগামী বাজেটে একটি ভারসাম্যপূর্ণ কর কাঠামো এবং ব্যবসাবান্ধব নীতিমালা তৈরিই হতে পারে এই সংকট মোকাবেলার পথ।
করজাল সম্প্রসারণ, অপ্রদর্শিত অর্থ বৈধ করার সুযোগ সীমিতকরণ, সুশাসন প্রতিষ্ঠা, এবং প্রশাসনিক দক্ষতা বৃদ্ধি করেও রাজস্ব আদায় সম্ভব বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা। ফলে, কর হার না কমিয়েও ব্যবসায়ীদের জন্য সহনীয় পরিবেশ তৈরি করা সম্ভব।
সরকার ও ব্যবসায়ী মহলের সমন্বিত উদ্যোগেই এ সংকটের সমাধান খুঁজে পাওয়া যেতে পারে বলে আশা করছেন সবাই।