ইলন মাস্কের মিত্রকে নাসার প্রধান করছেন না ট্রাম্প, ঘোষণা হবে নতুন নাম

যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার (NASA) পরবর্তী প্রশাসক হিসেবে জ্যারেড আইজ্যাকম্যানের মনোনয়ন প্রত্যাহার করে নিয়েছে ট্রাম্প প্রশাসন। এই সিদ্ধান্ত হোয়াইট হাউস থেকে গতকাল (শনিবার) আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হয়, যেখানে জানানো হয় যে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প শিগগিরই নতুন একজন প্রার্থীর নাম ঘোষণা করবেন। উল্লেখ্য, জ্যারেড আইজ্যাকম্যান ছিলেন ইলন মাস্কের ঘনিষ্ঠ সহযোগী এবং স্পেসএক্সের (SpaceX) বেসরকারি মহাকাশ অভিযানের অংশীদার।
এই ঘোষণার মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ নীতিতে নতুন এক মোড়ের ইঙ্গিত মিলেছে। প্রশ্ন উঠেছে—হোয়াইট হাউস কেন এমন একজন প্রার্থীকে প্রত্যাহার করল, যিনি একদিকে প্রযুক্তিনির্ভর ও বেসরকারি মহাকাশ খাতের শক্তিশালী প্রতিনিধি, অন্যদিকে খোদ মাস্কের সুপারিশপ্রাপ্ত?
মনোনয়ন প্রত্যাহারের পেছনে কী কারণ?
হোয়াইট হাউসের মুখপাত্র লিজ হিউস্টন এক বিবৃতিতে জানান, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নাসার মতো কৌশলগত একটি প্রতিষ্ঠানে এমন কাউকে বসাতে চান, যিনি ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতির প্রতি পূর্ণাঙ্গ সমর্থন রাখেন। তিনি বলেন, “নাসার নতুন প্রশাসক হতে হলে অবশ্যই সেই নীতির প্রতি অবিচল থাকা জরুরি।”
তবে হিউস্টন বা হোয়াইট হাউসের পক্ষ থেকে আইজ্যাকম্যানের মনোনয়ন প্রত্যাহারের নির্দিষ্ট কোনো কারণ প্রকাশ করা হয়নি। এমনকি এ নিয়ে ওয়াশিংটনের মহাকাশ, প্রতিরক্ষা ও প্রযুক্তি মহলে বিস্ময়ের সঞ্চার হয়েছে। অনেকে এটিকে ‘রাজনৈতিক ভারসাম্য রক্ষার সিদ্ধান্ত’ বলেও মন্তব্য করছেন।
কে এই জ্যারেড আইজ্যাকম্যান?
জ্যারেড আইজ্যাকম্যান একজন ধনকুবের প্রযুক্তি উদ্যোক্তা এবং ব্যক্তিগত মহাকাশ অভিযানে অংশ নেওয়া প্রথম মার্কিন নাগরিকদের অন্যতম। তিনি পেমেন্ট প্রসেসিং কোম্পানি শিফটফোর-এর (Shift4 Payments) সাবেক প্রধান নির্বাহী এবং ২০২১ সালে স্পেসএক্সের ‘ইনস্পিরেশন৪’ (Inspiration4) মিশনে কমান্ডার হিসেবে মহাকাশ ভ্রমণ করেন।
আইজ্যাকম্যানের মহাকাশ সংক্রান্ত উদ্যোগ এবং স্পেসএক্সের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার কারণে তিনি নাসার প্রশাসক হিসেবে ব্যাপক সমর্থন লাভ করছিলেন। কিন্তু অনেক আইনপ্রণেতা তাঁর মাস্কের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়েই উদ্বিগ্ন ছিলেন। স্পেসএক্সের পক্ষপাতমূলক সুবিধা পাওয়া কিংবা সরকারি সংস্থার ওপর প্রভাব বিস্তার নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন কয়েকজন সিনেটর।
মাস্কের প্রতিক্রিয়া: “এত হৃদয়বান মানুষ সচরাচর পাওয়া যায় না”
জ্যারেড আইজ্যাকম্যানের মনোনয়ন প্রত্যাহারের খবর ছড়িয়ে পড়তেই প্রতিক্রিয়া দেন ইলন মাস্ক। নিজের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ‘এক্স’-এ দেওয়া পোস্টে তিনি লেখেন, “এত দক্ষ ও হৃদয়বান মানুষ সচরাচর খুঁজে পাওয়া যায় না।”
তবে মাস্কের এই মন্তব্যের বাইরে এখন পর্যন্ত তাঁর পক্ষ থেকে কোনো আনুষ্ঠানিক বিবৃতি পাওয়া যায়নি।
ট্রাম্প প্রশাসন বনাম মাস্ক: সম্পর্ক কি অবনতির দিকে?
ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে ইলন মাস্কের সম্পর্ক সম্প্রতি কিছুটা শীতল হয়ে পড়েছে বলেই মনে করছেন হোয়াইট হাউস সংশ্লিষ্টরা। মাস্ক ছিলেন ট্রাম্পের গঠিত নতুন বিভাগ “Department of Government Efficiency”-এর প্রধান, যার মূল লক্ষ্য ছিল সরকারি ব্যয় কমিয়ে আনা। কিন্তু ট্রাম্পের একাধিক উপদেষ্টা মনে করেন, এই বিভাগে মাস্কের কাজ সন্তোষজনক হয়নি। ফলে মাস্কের সঙ্গে প্রশাসনের দূরত্ব তৈরি হয় এবং তারই ধারাবাহিকতায় আইজ্যাকম্যানের মনোনয়ন বাতিল বলে ধরে নেওয়া হচ্ছে।
নতুন মুখ: স্টিভেন কোয়াস্ট?
আইজ্যাকম্যানের স্থানে নাসার নতুন প্রধান হিসেবে যাঁর নাম সবচেয়ে বেশি আলোচনায় রয়েছে, তিনি হলেন যুক্তরাষ্ট্রের বিমানবাহিনীর সাবেক লেফটেন্যান্ট জেনারেল স্টিভেন কোয়াস্ট। তিনি ট্রাম্প প্রশাসনের ঘনিষ্ঠ এবং মার্কিন মহাকাশবাহিনী গঠনের প্রথমদিকের অন্যতম সমর্থক ছিলেন।
স্টিভেন কোয়াস্টের পক্ষে সবচেয়ে বড় যুক্তি হলো—তিনি একজন উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তা হিসেবে মহাকাশকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা ও আধিপত্য বিস্তারের অঙ্গ হিসেবে দেখেন। আর প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের নতুন নীতিতে মহাকাশ নিয়ে কৌশলগত ও প্রতিরক্ষা-ভিত্তিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রাধান্য পাচ্ছে।
মহাকাশখাতের প্রতিক্রিয়া: অনিশ্চয়তা ও হতাশা
যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশশিল্পের সঙ্গে যুক্ত অনেকেই এই মনোনয়ন প্রত্যাহারকে নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখছেন। তাঁদের ভাষায়, “একজন দূরদর্শী ও সাহসী উদ্যোগপতির নেতৃত্বে নাসা হয়তো আরও উদ্ভাবনী পথ বেছে নিত।”
অন্যদিকে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ট্রাম্প প্রশাসন চাইছে নাসাকে তার পুরোনো সামরিক ও কৌশলগত ধারা অনুযায়ী পরিচালিত করতে, যেখানে ব্যবসায়ী বা উদ্ভাবকের চেয়ে বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে সামরিক নীতি ও রাজনৈতিক আনুগত্য।
নাসার ভবিষ্যৎ কোন পথে?
নাসা শুধু একটি মহাকাশ সংস্থা নয়, এটি যুক্তরাষ্ট্রের বৈজ্ঞানিক অগ্রগতির প্রতীক। প্রশাসনিক সিদ্ধান্তে বারবার পরিবর্তন এবং রাজনৈতিক বিবেচনায় গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ বাতিল—এসব প্রশ্ন তুলছে, আমেরিকার মহাকাশনীতি কি রাজনীতির হাতে জিম্মি হয়ে পড়ছে?
এখন প্রশ্ন হলো, কে হবেন নাসার পরবর্তী প্রশাসক? তিনি কি হবেন একজন বিজ্ঞান-ভিত্তিক দূরদর্শী নেতা, না কি হবেন সামরিক কৌশলের প্রধানে থাকা একজন অভিজ্ঞ কর্মকর্তা?
সবকিছুর উত্তর হয়তো মিলবে আগামী কয়েক দিনের মধ্যেই, যখন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নতুন প্রার্থীর নাম ঘোষণা করবেন।