বাংলাদেশ পাকিস্তান টি-টোয়েন্টি, ১৮ বছর পর ইতিহাস

আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে বাংলাদেশ ও পাকিস্তান দুই দল দীর্ঘ ১৮ বছর ধরে একে অপরের মুখোমুখি হয়েছে মোট ২২ বার। এই সময়ের মধ্যে উভয় দলই পারফরম্যান্সে ওঠাপড়ার মধ্য দিয়ে গেছে, তবে দু’দেশের এই দ্বৈরথ আজও ভক্তদের মনে রোমাঞ্চ জাগিয়ে তোলে। আজকের প্রতিবেদনে আমরা এই দুই দলের টি-টোয়েন্টির যাত্রাপথ, উল্লেখযোগ্য ম্যাচগুলো এবং সাম্প্রতিক ম্যাচের সংক্ষিপ্ত বিশ্লেষণ নিয়ে আলোচনা করবো।
টি-টোয়েন্টিতে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের প্রথম টক্কর: কেনিয়া, ২০০৭
বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের প্রথম টি-টোয়েন্টি ম্যাচটি হয়েছিল ২০০৭ সালে কেনিয়ায় চার জাতি সিরিজে। এই সিরিজে বাংলাদেশ, পাকিস্তান, কেনিয়া ও উগান্ডা অংশ নিয়েছিল। উগান্ডার ম্যাচগুলো আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি না পেলেও, নাইরোবির জিমখানা গ্রাউন্ডে পাকিস্তান ৭ উইকেটে ১৯১ রান করে। এরপর বাংলাদেশের ব্যাটিং লাইনআপ ৭ উইকেট হারিয়ে ১৬১ রান সংগ্রহ করে। ম্যাচের সবচেয়ে আলোচিত ব্যাটসম্যান ছিলেন বাংলাদেশের ওপেনার নাজিমউদ্দিন, যিনি ৫০ বলে ৮১ রানের ঝড়ো ইনিংস খেলেছিলেন।
২০০৮: মনসুর আমজাদের এক ওভারে ৩ উইকেট, কিন্তু তবুও পরাজয়
২০০৮ সালে বাংলাদেশ পাকিস্তান সফরে একটি মাত্র টি-টোয়েন্টি খেলেছিল। টসে জিতে পাকিস্তান প্রথমে ব্যাট করে ৫ উইকেটে ২০৩ রান করে। বাংলাদেশ রান তাড়া করতে গিয়ে ১৫ ওভার শেষে ৯৮/৭ এ আটকে ছিল। তখনই অভিষিক্ত লেগ স্পিনার মনসুর আমজাদ প্রথম বল হাতে নেন এবং একটি মাত্র ওভারে তিন উইকেট তুলে নিয়ে দর্শকদের তাক লাগিয়ে দেন। মাহমুদউল্লাহ, মাশরাফি ও শাহাদাতের উইকেট তুলে নেওয়া মনসুরের এই স্পেলটি ছিল তার আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টির প্রথম ও শেষ ম্যাচেও। যদিও ওই ম্যাচে পাকিস্তানই জয়ী হয়েছিল।
২০১৫: মোস্তাফিজ-সৌম্যর অভিষেক আর প্রথম জয়
২০১৫ সালে পাকিস্তানের বাংলাদেশ সফরে টি-টোয়েন্টি একমাত্র ম্যাচে বাংলাদেশ ৭ ম্যাচ পর পাকিস্তানের বিপক্ষে জয়ী হয়। এই ম্যাচে মোস্তাফিজুর রহমান ও সৌম্য সরকার আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে অভিষেক ঘটান। মোস্তাফিজ দুর্দান্ত বোলিং করে ৪ ওভারে ২/২০ রেকর্ড করেন। অন্যদিকে, সাকিব আল হাসানও ৪ ওভারে মাত্র ১৭ রান খরচ করে বোলিং করেছিলেন। সাব্বির রহমান অপরাজিত ৩২ বলে ৫১ রানের ইনিংস খেলেন, যা দলকে ৭ উইকেটে ২২ বল হাতে রেখেই জয় নিশ্চিত করে। উল্লেখযোগ্য ছিল সৌম্যের দুর্ভাগ্য, ইনিংস শুরু করার আগেই তিনি রানআউট হন।
২০২৪-২৫ এশিয়া কাপ: মিরপুরে বাংলাদেশের দ্বিতীয় জয়
বাংলাদেশ ও পাকিস্তান ১১ মাস পর আবার টি-টোয়েন্টিতে মুখোমুখি হয় মিরপুর শের-ই-বাংলা স্টেডিয়ামে। সেই ম্যাচেও বাংলাদেশের জয় হয়েছে। মিরপুরের উইকেটে বোলাররা পাকিস্তানকে ১২৯/৭ এ আটকে দেয়। সৌম্য সরকার ৪৮ বল খেলে ৪৮ রান করে ম্যাচ সেরার পুরস্কার পান। বাংলাদেশ ৫ বল ও ৫ উইকেট হাতে রেখেই ম্যাচটি জয় করে ফাইনালে জায়গা করে নেয়।
একদিনে দুই ম্যাচ: ২০২৩ এশিয়ান গেমসের অসাধারণ কীর্তি
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ছিল বাংলাদেশের জন্য আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের স্মরণীয় দিন। একদিনে দুই আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলেছিল বাংলাদেশ। চীনের হাংঝুতে পাকিস্তানের বিপক্ষে এশিয়ান গেমসে টি-টোয়েন্টি এবং ভারতের ধর্মশালায় ওয়ানডে বিশ্বকাপে আফগানিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচ। উভয় ম্যাচেই বাংলাদেশ জয়ী হয়। বিশেষত, হাংঝুতে পাকিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচটি ছিল ব্রোঞ্জপদকের লড়াই। পাকিস্তান ৫ ওভারে ১ উইকেটে ৪৮ রান তোলার পর বৃষ্টি নামায় ম্যাচ সাময়িক বন্ধ হয়। পুনরায় শুরু হলে বাংলাদেশের লক্ষ্য দাঁড়ায় ৬৫ রান। শেষ ওভারে প্রয়োজন ছিল ২০ রান। ইয়াসির আলী ফিরে গেলেও শেষ বলেই রাকিবুল ইসলামের চার মেরে বাংলাদেশ ব্রোঞ্জপদক নিশ্চিত করে।
মোস্তাফিজ ও সৌম্যের অভিজ্ঞতার পার্থক্য
বাংলাদেশের বর্তমান টি-টোয়েন্টি দলটিতে মোস্তাফিজুর রহমান এবং সৌম্য সরকার দুইটি গুরুত্বপূর্ণ নাম। মোস্তাফিজ তার অভিজ্ঞতা ও ধারাবাহিক বোলিং দিয়ে দলের সেরা বলার মতো অবদান রাখে, যেখানে সৌম্য সরকারের ইনিংস অনেক সময় টিমের ভরসা হয়ে দাঁড়ায়। তবে দুইজনের ক্যারিয়ারের শুরুটা একই, ২০১৫ সালে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে অভিষেক। মোস্তাফিজ বোলিংয়ে স্বতন্ত্র পারফরম্যান্স দেখিয়েছেন, আর সৌম্য ব্যাটিংয়ে ঝড় তুলে ম্যাচের ধারা বদলে দিয়েছেন। তাদের এই বিপরীত অভিজ্ঞতা দলের জন্য অনেক বড় সম্পদ।
বাংলাদেশের ক্রিকেটে পাকিস্তানের সঙ্গে দ্বৈরথের গুরুত্ব
বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের ক্রিকেট ইতিহাস শুধু একটি প্রতিযোগিতা নয়, বরং দুটি দেশের ক্রিকেট সংস্কৃতির বড় অধ্যায়। পাকিস্তানের মতো একটি শক্তিশালী দলকে পরাস্ত করে বাংলাদেশ ক্রিকেট বিশ্বে আত্মপ্রত্যয়ের বহিঃপ্রকাশ ঘটায়। বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে পাকিস্তানের বিপক্ষে অর্জিত প্রত্যেক জয় দলের উন্নয়নের স্বাক্ষর। বিশেষত টি-টোয়েন্টিতে এই জয়গুলো তরুণ খেলোয়াড়দের আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধিতে সাহায্য করেছে।
ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা ও নতুন প্রজন্ম
বর্তমান প্রজন্মের ক্রিকেটাররা, যেমন সৌম্য সরকার, মোস্তাফিজুর রহমান, সাকিব আল হাসান, তামিম ইকবাল প্রমুখ, আগামি বছরগুলোতে বাংলাদেশের ক্রিকেটকে আরও নতুন উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারবে বলে আশা করা যাচ্ছে। পাকিস্তান ও অন্যান্য শক্তিশালী দলের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এই তরুণরা দেশের ক্রিকেটের ভবিষ্যত গড়বে।
বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের টি-টোয়েন্টি দ্বৈরথ ১৮ বছরের ইতিহাসে অনেক স্মৃতি, উত্থান-পতন আর উচ্ছ্বাসের গল্প বয়ে এনেছে। ২০০৭ থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত ২২ ম্যাচের এই প্রতিদ্বন্দ্বিতা ক্রিকেট প্রেমীদের জন্য এক অনন্য উৎসব। আজকের ম্যাচগুলো শুধু খেলাই নয়, দুই দেশের ক্রিকেট সংস্কৃতির বিনিময়ও বটে। আগামীদিনে এই দ্বৈরথ আরও জাঁকিয়ে উঠবে, নতুন নতুন নায়ক গড়ে উঠবে।
বাংলাদেশ ক্রিকেটপ্রেমীরা এখনো মোস্তাফিজ, সৌম্যদের সেই দুর্দান্ত পারফরম্যান্স এবং একদিনে দুই ম্যাচের অসাধারণ জয় স্মরণ করছে। এ যেনো বাংলাদেশের ক্রিকেটে নতুন অধ্যায়ের সূচনা।