প্রযুক্তি

২০২৮ সালের মধ্যে চীনে বিক্রি হওয়া অর্ধেক ভারি ট্রাক হবে বিদ্যুৎচালিত

চীনের রাস্তায় বৈদ্যুতিক যানবাহনের আধিপত্য দিনকে দিন স্পষ্ট হয়ে উঠছে। ব্যক্তিগত গাড়ির পাশাপাশি এবার বাণিজ্যিক পরিবহন ক্ষেত্রেও বৈপ্লবিক পরিবর্তনের পথে হাঁটছে বিশ্বের বৃহত্তম গাড়ির বাজারটি। এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়েই চীনের অন্যতম ব্যাটারি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান সিএটিএল (CATL)–এর চেয়ারম্যান জেং য়্যুকুন ঘোষণা দিলেন, ২০২৮ সালের মধ্যে চীনে বিক্রি হওয়া ভারি ট্রাকের অন্তত ৫০ শতাংশই হবে বিদ্যুৎচালিত।

এই ঘোষণা চীনের পরিবহন খাতে একটি যুগান্তকারী রূপান্তরের ইঙ্গিত দিচ্ছে, যেখানে একদিকে কমবে জীবাশ্ম জ্বালানির নির্ভরতা, অন্যদিকে টেকসই পরিবহন ব্যবস্থার প্রসার ঘটবে।

বর্তমানে বিদ্যুৎচালিত ভারি ট্রাকের অবস্থা

বর্তমানে চীনে বিক্রি হওয়া ভারি ট্রাকের মধ্যে বিদ্যুৎচালিত ট্রাকের পরিমাণ প্রায় ৪০ শতাংশের কাছাকাছি। এটি ২০২৪ সালের তুলনায় উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি। আগামী চার বছরের মধ্যে আরও ১০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হলে, চীনের বাজারে বিদ্যুৎচালিত ভারি ট্রাক আধিপত্য স্থাপন করতে সক্ষম হবে।

জেং য়্যুকুন বলেন, “বৈদ্যুতিক ভারি ট্রাকের বাজারে চাহিদা শুধু বাড়ছে না, এটি এখন টেকসই ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রয়োজনেও পরিণত হয়েছে। পরিবেশগত চ্যালেঞ্জ ও জ্বালানির অস্থির বাজার পরিস্থিতি আমাদের এই দিকে ঠেলে দিচ্ছে।”

বিকল্প জ্বালানির চাহিদা ও সমস্যা

গত কয়েক বছর ধরেই চীনে LNG (Liquefied Natural Gas)–চালিত ভারি ট্রাকের ব্যবহার ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে জ্বালানি চাহিদাও। ফলে গ্যাসের দাম বাড়ছে এবং সরবরাহে তৈরি হচ্ছে অস্থিরতা। এই পরিস্থিতিতে অনেক পরিবহন কোম্পানি ব্যয়ের চাপে পড়ছে এবং দীর্ঘমেয়াদে টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়ছে।

জেং য়্যুকুনের মতে, এই সংকট থেকেই বৈদ্যুতিক ট্রাকের দিকে ঝুঁকছে পরিবহন খাত। কারণ বৈদ্যুতিক যানবাহন শুধু পরিবেশবান্ধব নয়, বরং এর অপারেটিং খরচও তুলনামূলক কম।

CATL-এর মেগা প্রকল্প: শক্তি শিল্পে বৈপ্লবিক ধাক্কা

শুধু পূর্বাভাস দিয়েই থেমে থাকেননি জেং য়্যুকুন। CATL ইতিমধ্যেই তাদের উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনার বাস্তবায়ন শুরু করেছে। সম্প্রতি তারা উত্তর চীনের শ্যানডং প্রদেশে ৬০ গিগাওয়াট-হাওয়ার সক্ষমতার একটি এনার্জি স্টোরেজ ও EV ব্যাটারি উৎপাদন কারখানা চালু করেছে। এটি CATL-এর উত্তর চীন অঞ্চলে প্রথম এবং সর্ববৃহৎ প্রকল্প।

স্থানীয় সোশ্যাল মিডিয়া উইচ্যাটে CATL জানিয়েছে, প্রকল্পটির দ্বিতীয় ও তৃতীয় ধাপ আগামী দুই বছরের মধ্যেই সম্পন্ন করা হবে। লক্ষ্য হলো একটি পূর্ণাঙ্গ ব্যাটারি ক্লাস্টার তৈরি করা, যার মাধ্যমে পুরো উত্তর চীন অঞ্চলের ইলেকট্রিক যানবাহন শিল্প আরও ত্বরান্বিত হবে।

লিথিয়াম ব্যাটারির গ্লোবাল হাব গড়ে তুলছে চীন

শ্যানডং অঞ্চলে এ বছরের মধ্যেই ১০০ বিলিয়ন ইউয়ান (প্রায় ১৪ বিলিয়ন ডলার) বিনিয়োগে একটি সম্পূর্ণ লিথিয়াম ব্যাটারি ইন্ডাস্ট্রি গড়ে তোলা হচ্ছে। স্থানীয় সরকারের তথ্য অনুযায়ী, এই ইন্ডাস্ট্রিতে থাকবে:

  • ইলেকট্রোড ম্যাটেরিয়াল প্রস্তুতকারক সুবিধা
  • ইলেকট্রোলাইটস উৎপাদন কেন্দ্র
  • ব্যাটারি সেল উৎপাদন লাইন
  • এবং ব্যাটারি অ্যাসেম্বলি প্ল্যান্ট

এত বড় পরিসরের উৎপাদন কেন্দ্র চীনের ব্যাটারি প্রযুক্তিতে স্বনির্ভরতা অর্জন ও বৈশ্বিক বাজারে আধিপত্য বজায় রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

চীনের বৈদ্যুতিক যানবাহন কৌশল: বৈশ্বিক নেতৃত্বের পথে

চীন দীর্ঘদিন ধরেই ইলেকট্রিক ভেহিকল (EV) প্রযুক্তিকে জাতীয় অগ্রাধিকার হিসেবে বিবেচনা করছে। সরকার EV উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে নানা ধরনের ট্যাক্স ছাড়, ইনসেনটিভ ও গবেষণা-উন্নয়ন সহায়তা দিয়ে উৎসাহিত করছে।

বিশ্বে EV বিক্রির শীর্ষে রয়েছে চীন, যেখানে ২০২৪ সালেই ৯০ লাখের বেশি বিদ্যুৎচালিত গাড়ি বিক্রি হয়েছে। শুধু ব্যক্তিগত গাড়ি নয়, চীন এখন বাণিজ্যিক যান—বিশেষ করে বাস ও ট্রাক—খাতে ব্যাপকভাবে বৈদ্যুতিকীকরণ শুরু করেছে।

পরিবেশ ও অর্থনীতির জন্য ইতিবাচক বার্তা

বিদ্যুৎচালিত ভারি ট্রাক পরিবেশগত দিক থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ভারি ট্রাক সাধারণত বেশি পরিমাণে ডিজেল ব্যবহার করে এবং বিপুল পরিমাণে কার্বন ডাই-অক্সাইড (CO₂), নাইট্রোজেন অক্সাইড (NOx) ও অন্যান্য ক্ষতিকর নির্গমন ঘটায়। বৈদ্যুতিক ট্রাকে এই নির্গমন প্রায় শূন্য।

এছাড়া, দীর্ঘমেয়াদে বিদ্যুৎচালিত ট্রাকের অপারেটিং খরচ উল্লেখযোগ্য হারে কম হয়, যেটা পরিবহন খাতের জন্য অর্থনৈতিকভাবেও লাভজনক।

বিশ্লেষকদের মত: বাজারে দ্রুত পরিবর্তন আসছে

বিশ্লেষকরা মনে করছেন, চীন এখন আর শুধু “গাড়ির বাজার” নয়, বরং “গাড়ি প্রযুক্তির বিশ্বনেতা” হওয়ার পথে এগোচ্ছে। CATL-এর মতো কোম্পানিগুলো একদিকে বিশ্বে ব্যাটারি সরবরাহে নেতৃত্ব দিচ্ছে, অন্যদিকে বৈদ্যুতিক যানবাহনের প্রযুক্তি ও অবকাঠামো গড়ে তুলছে।

চীনে বৈদ্যুতিক ভারি ট্রাকের বিকাশ শুধু একটি প্রযুক্তিগত অগ্রগতি নয়, এটি দেশের অর্থনীতি, জ্বালানি নিরাপত্তা ও পরিবেশ সংরক্ষণের দিক থেকেও এক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। ২০২৮ সালের মধ্যে ভারি ট্রাকের অর্ধেক বিদ্যুৎচালিত হলে চীন বৈশ্বিক EV বিপ্লবে নেতৃত্বের আসনে আরো দৃঢ়ভাবে বসতে পারবে।

CATL-এর উদ্যোগ, সরকারের সহায়তা ও বাজারের চাহিদা—এই তিন শক্তির সমন্বয়ে চীন এক টেকসই পরিবহন ব্যবস্থার নতুন অধ্যায়ের সূচনা করছে।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button