কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় বিশাল প্রবৃদ্ধি, কর্মসংস্থানে ধসের আশঙ্কা

বিশ্বব্যাপী কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (Artificial Intelligence – AI) প্রযুক্তির অগ্রযাত্রা একদিকে নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলছে, অন্যদিকে বাড়িয়ে দিচ্ছে অর্থনৈতিক বৈষম্য ও শ্রমবাজারের অনিশ্চয়তা। জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়ন বিষয়ক সংস্থা ইউএনসিটিএডি (UNCTAD) প্রকাশিত এক সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, ২০৩৩ সালের মধ্যে বৈশ্বিক এআই বাজারের আকার দাঁড়াবে ৪.৮ ট্রিলিয়ন ডলার, যা বর্তমানে জার্মানির অর্থনীতির সমান। পাশাপাশি, বিশ্বব্যাপী ৪০ শতাংশ চাকরি এআই প্রযুক্তির কারণে ঝুঁকিতে পড়বে বলে সতর্ক করেছে সংস্থাটি।
জ্ঞানভিত্তিক পেশা সবচেয়ে বেশি হুমকির মুখে
ইউএনসিটিএডির বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, অতীতের প্রযুক্তি বিপ্লবগুলো মূলত নিম্ন-দক্ষতা সম্পন্ন ও শ্রমনির্ভর চাকরিতে প্রভাব ফেললেও, এআই বিপ্লব সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলবে জ্ঞানভিত্তিক খাতগুলোতে—যেমন প্রশাসন, আইন, গবেষণা, প্রোগ্রামিং, গ্রাফিক ডিজাইন প্রভৃতি। এই কারণে উন্নত অর্থনীতিগুলো তুলনামূলকভাবে বেশি ক্ষতির মুখে পড়তে পারে, যদিও তারা এআই ব্যবহারে অধিকতর প্রস্তুত।
উন্নয়নশীল দেশগুলোর প্রতিযোগিতা হুমকিতে
বড় প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো এখন দ্রুত গতিতে এআই প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে উৎপাদন, সেবা ও তথ্য বিশ্লেষণের মতো খাতগুলোতে কর্মী নির্ভরতা কমাচ্ছে। এতে উন্নয়নশীল দেশগুলোর সস্তা শ্রমভিত্তিক প্রতিযোগিতামূলক সুবিধা নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ফলে, গ্লোবাল সাপ্লাই চেইনে তাদের অংশগ্রহণ কমে যাওয়ার ঝুঁকি দেখা দিচ্ছে।
মানবিক বিবেচনা ও আন্তর্জাতিক নীতিমালার আহ্বান
ইউএনসিটিএডির মহাসচিব রেবেকা গ্রিনস্প্যান বলেছেন, “প্রযুক্তি নয়, মানুষ যেন কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে—এই দৃষ্টিভঙ্গি নিয়েই এআই উন্নয়ন পরিচালিত হওয়া উচিত।” তিনি আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ও বৈশ্বিক নীতিমালা তৈরির উপর গুরুত্ব দিয়ে বলেন, একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক এআই কাঠামো গঠনের জন্য সকল দেশকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।
বাজারের দ্রুত সম্প্রসারণ ও নেতৃত্বের কেন্দ্রীকরণ
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ২০২৩ সালে এআই, ব্লকচেইন, ইন্টারনেট অব থিংস, ৫জি ও ৩ডি প্রিন্টিংসহ উদীয়মান প্রযুক্তি খাতগুলোর সম্মিলিত বাজার ছিল ২.৫ ট্রিলিয়ন ডলার। আগামী দশকে এটি ছয় গুণ বেড়ে ১৬.৪ ট্রিলিয়ন ডলারে পৌঁছাবে, যার মধ্যে সবচেয়ে বড় অবদান থাকবে এআই খাতের।
বর্তমানে শীর্ষ ১০০টি এআই কোম্পানির বেশিরভাগই যুক্তরাষ্ট্র ও চীনে অবস্থিত, এবং তারা বৈশ্বিক করপোরেট গবেষণা ও উন্নয়নে ৪০ শতাংশ অর্থ ব্যয় করছে। এতে করে উন্নয়নশীল দেশের প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ছে।
অংশগ্রহণহীন ১১৮টি দেশ ও ন্যায্য নীতির অভাব
জাতিসংঘের এই প্রতিবেদন অনুযায়ী, উন্নয়নশীল ১১৮টি দেশ এখনো বৈশ্বিক এআই নীতিমালা ও আইন প্রণয়নের আলোচনায় অংশগ্রহণ করছে না। এর ফলে ভবিষ্যতের প্রযুক্তিনির্ভর বিশ্বের নীতি ও কাঠামো শুধু কিছু ধনী দেশের নিয়ন্ত্রণে চলে যেতে পারে।
সমাধান: সক্ষমতা বৃদ্ধি ও নীতিগত প্রস্তুতি
ইউএনসিটিএডি সুপারিশ করেছে, এখনই সকল দেশকে ডিজিটাল অবকাঠামোতে বিনিয়োগ, মানবসম্পদ উন্নয়ন এবং ন্যায্য এআই শাসন কাঠামো তৈরিতে কাজ শুরু করতে হবে।
এআই যেমন পুরনো চাকরি প্রতিস্থাপন করছে, তেমনি এটি নতুন শিল্প, দক্ষতা ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির সুযোগও তৈরি করছে। তবে এর জন্য প্রয়োজন সরকারের সঠিক নীতিমালা, বিনিয়োগ ও সচেতনতা।
বিশ্বের অর্থনীতিতে এআই একটি নতুন যুগের সূচনা করছে। তবে এই প্রযুক্তির সুবিচার ও টেকসই প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হলে উন্নয়নশীল দেশগুলোকেও সমানভাবে আলোচনায় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। নীতিনির্ধারণে অংশগ্রহণ ও প্রস্তুতি ছাড়া এআই আগামীতে বৈষম্য আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে।
তথ্যসূত্র: এএফপি | UNCTAD Report 2025