স্বয়ংক্রিয় ভ্যাট ব্যবস্থা না আসা পর্যন্ত নিরীক্ষা বন্ধ: এনবিআর চেয়ারম্যান

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খান বলেছেন, স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতি বা অটোমেশন চালু হওয়ার আগে পর্যন্ত প্রয়োজনে কেয়ামত পর্যন্ত ভ্যাট নিরীক্ষা বন্ধ থাকবে। ব্যবসায়ীরা যাতে অযথা হয়রানির শিকার না হন, সেজন্য এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।
তিনি বলেন,
“আমরা চাই না ব্যবসায়ীরা ভাবুক, অহেতুক হয়রানি করার জন্য নিরীক্ষা চালানো হচ্ছে। পুরো ভ্যাট ব্যবস্থাকে প্রযুক্তিনির্ভর করা হচ্ছে। তাই নতুন সিস্টেম না আসা পর্যন্ত নিরীক্ষা কার্যত বন্ধ থাকবে।”
আজ মঙ্গলবার গুলশানের একটি হোটেলে গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) আয়োজিত ‘কর ও ভ্যাট সংস্কার’ বিষয়ক এক সংলাপে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ মন্তব্য করেন। অনুষ্ঠানে ব্যবসায়ী নেতা, উদ্যোক্তা ও অর্থনীতিবিদরা উপস্থিত ছিলেন।
অটোমেশন ছাড়া ভ্যাটে স্বচ্ছতা আসবে না
এনবিআর চেয়ারম্যান জানান, দেশে কর ব্যবস্থায় বড় সংস্কার চলছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো একক ভ্যাট হার নির্ধারণ এবং স্বয়ংক্রিয় ভ্যাট সিস্টেম চালু করা।
তিনি বলেন,
“বর্তমানে ভ্যাট পরিশোধের জন্য কারও কাছে যেতে হয় না। এক ক্লিকেই অনলাইনে ভ্যাট দেওয়া যায়। কিন্তু নিরীক্ষা ও যাচাইয়ের ক্ষেত্রে অটোমেশন ছাড়া পূর্ণ স্বচ্ছতা আসবে না। তাই অটোমেশন না হওয়া পর্যন্ত ভ্যাট নিরীক্ষা করা হবে না।”
ব্যবসায়ীরা অনেক সময় অভিযোগ করেন যে, ভ্যাট নিরীক্ষার নামে হয়রানি করা হয়। এ বিষয়ে চেয়ারম্যান বলেন,
“আমরা ব্যবসায়ীদের হয়রানি করতে চাই না। এজন্য পুরো সিস্টেমকে ডিজিটাল ও স্বয়ংক্রিয় করতে হবে। এতে সরকারের রাজস্ব আদায় যেমন বাড়বে, তেমনি ব্যবসার পরিবেশও সহজ হবে।”
ভ্যাট সংস্কারে ব্যবসায়ীদের বাধা
এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন,
“আমরা একটি একক ভ্যাট হার নির্ধারণ করতে চাই। কিন্তু ব্যবসায়ীরাই এতে বাধা হয়ে দাঁড়ান। কেউ চান কম হারে, কেউ চান বেশি ছাড়। ফলে একক হারে পৌঁছানো কঠিন হয়ে যায়।”
তিনি আরও যোগ করেন,
“বর্তমানে দেশে বিভিন্ন খাতে বিভিন্ন ভ্যাট হার রয়েছে। এতে সিস্টেম জটিল হয় এবং কর ফাঁকি দেওয়ার সুযোগ তৈরি হয়। এজন্য একক হার প্রয়োজন।”
রাজস্ব ঘাটতি ও ঋণের চাপ
আবদুর রহমান খান বলেন,
“বিদেশি ঋণের বোঝা অনেক বেড়েছে। যদি নিজস্ব রাজস্ব বাড়াতে না পারি, তাহলে এই ঋণ পরিশোধ করা বিপজ্জনক হয়ে যাবে।”
তিনি স্বীকার করেন, রাজস্ব খাতে অদক্ষতা রয়েছে এবং সেগুলো কাটিয়ে ওঠা জরুরি।
“আমাদের নীতি নির্ধারণে এত সময় চলে যায় যে, বাস্তবায়নে সময় পাওয়া যায় না। এজন্য রাজস্ব বিভাগকে দুটি ভাগে ভাগ করা হবে। যাতে একজনের জায়গায় দুজন কাজ করে দ্রুত অগ্রগতি হয়।”
করের ছাড়ে অনিয়মের অভিযোগ
এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন,
“দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ বাড়াতে আমরা কর ছাড় দেই। সাধারণত আট বছরের জন্য কর ছাড় দেওয়া হয়। কিন্তু দেখা যায়, সেই ছাড় ৪০ বছর পর্যন্ত চলে যায়। এটি রাজস্বের জন্য বড় ক্ষতি।”
তিনি বলেন, ভবিষ্যতে ন্যূনতম করহার বিধানও পরিবর্তন করা হবে।
“আমরা জানি, এটি ব্যবসায়ীদের জন্য সমস্যা। কিন্তু হঠাৎ তুলে দিলে রাজস্ব কমে যাবে। তাই ধাপে ধাপে সংস্কার করা হবে।”
বিশ্লেষণ: কেন ভ্যাট অটোমেশন জরুরি?
বাংলাদেশে রাজস্ব আদায়ের অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ হলো কর ফাঁকি। বিশেষ করে ভ্যাট নিরীক্ষার জটিলতা ব্যবসায়ী ও প্রশাসনের মধ্যে অবিশ্বাস তৈরি করেছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে—
- অটোমেশন চালু হলে ভ্যাট জমা, যাচাই ও নিরীক্ষা সব অনলাইনে হবে।
- মানবিক হস্তক্ষেপ কমবে, ফলে হয়রানির সুযোগ থাকবে না।
- ব্যবসায়ীরা সহজে কর দিতে উৎসাহিত হবেন।
এছাড়া, রাজস্ব বৃদ্ধি না হলে উন্নয়ন প্রকল্পে অর্থের সংকট তৈরি হবে এবং বিদেশি ঋণের ওপর নির্ভরশীলতা বাড়বে।
সিপিডি’র প্রস্তাবনা
সংলাপে সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন,
“কর ও ভ্যাট ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা আনতে হলে অটোমেশন বাধ্যতামূলক করতে হবে। পাশাপাশি কর ফাঁকি রোধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।”
তিনি আরও বলেন,
“ব্যবসায়ীদের হয়রানি কমাতে প্রযুক্তি ব্যবহার অপরিহার্য। তবে এক্ষেত্রে এনবিআরের সক্ষমতাও বাড়াতে হবে।”
ব্যবসায়ীদের দাবি
ব্যবসায়ী নেতারা বলেন,
- ভ্যাটে জটিলতা দূর করতে একক হার নির্ধারণ করা উচিত।
- হয়রানি বন্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।
- কর প্রদানে সহজ পদ্ধতি চালু করতে হবে।
তাদের মতে, করদাতাদের আস্থা ফিরিয়ে আনতে দৃশ্যমান পরিবর্তন জরুরি
এনবিআরের চেয়ারম্যানের বক্তব্যে স্পষ্ট যে, সরকার অটোমেশন ছাড়া ভ্যাট নিরীক্ষা চালাবে না। এর মাধ্যমে ব্যবসায়ীরা স্বস্তি পেলেও রাজস্ব খাতে সংস্কারের গতি বাড়ানো জরুরি। অন্যথায় ঋণের চাপ ও রাজস্ব ঘাটতি অর্থনীতিকে ঝুঁকিতে ফেলবে।
MAH – 12495 , Signalbd.com