বানিজ্য

নতুন বাজেটে কর বৃদ্ধির প্রস্তাবে পোল্ট্রি খাত হুমকির মুখে

আগামী অর্থবছরের বাজেটে পোল্ট্রি খাতে কর বৃদ্ধির প্রস্তাবের ফলে ডিম ও মুরগির দাম বাড়ার শঙ্কা প্রকাশ করেছেন দেশের পোল্ট্রি শিল্পের শীর্ষ সংগঠনগুলো। তারা বলছেন, করের বোঝা বাড়ানো হলে উৎপাদন খরচ বেড়ে যাবে, যা সরাসরি ভোক্তাদের ওপর প্রভাব ফেলবে এবং খাদ্যে প্রোটিন সংকটও দেখা দিতে পারে। তাই ন্যায্য ও সহনীয় কর ব্যবস্থা না নিলে দেশের পোল্ট্রি শিল্প ও সাধারণ মানুষ দুটোই বিপাকে পড়বে।

পোল্ট্রি খাতে কর বৃদ্ধির প্রস্তাব ও তার প্রভাব

২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটে পোল্ট্রি শিল্পের কর হার উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ানো হয়েছে। করপোরেট কর ১৫ শতাংশ থেকে সাড়ে ২৭ শতাংশে উন্নীত করা হয়েছে এবং টার্নওভার কর দশমিক ৬ শতাংশ থেকে এক শতাংশে নিয়ে আসা হয়েছে। এর ফলে খাতে নতুন বিনিয়োগ কমে যেতে পারে এবং উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি পেয়ে বাজারে ডিম ও মুরগির মূল্য ওঠানামা করবে।

পোল্ট্রি খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, খাতে এই কর বৃদ্ধি হলে উৎপাদকরা উৎপাদন খরচ সামলাতে পারবেন না, যা স্বাভাবিকভাবেই ভোক্তা পর্যায়ে দাম বৃদ্ধির দিকে ধাবিত করবে। বিশেষ করে বর্তমানে পোল্ট্রি শিল্পে কাঁচামালের ওপর বিদেশি মুদ্রায় বড় অঙ্কের ব্যয় হয়। কর বৃদ্ধির কারণে আমদানি খরচ বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, যা শেষ পর্যন্ত ডিম-মাংসের দামে সরাসরি প্রতিফলিত হবে।

পোল্ট্রি খাতের বৃহত্তম সংগঠনগুলোর উদ্বেগ ও দাবি

বিপিআইসিসি (বাংলাদেশ পোল্ট্রি ইন্ডাস্ট্রি চেম্বার অব কমার্স) এর আহ্বায়ক শামসুল আরেফিন খালেদ বলেন, “পোল্ট্রি খাত দেশের ম্যাক্রো ইকোনমিক কাঠামোতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। সরকার যখন এই খাতে কর বাড়ানোর কথা ভাবছে, তখন তাকে পুরো অর্থনীতির ওপর প্রভাব বিবেচনা করতে হবে। আমরা চাই দেশের মানুষ কম খরচে ভালো প্রোটিন পায়, তাই কর বাড়ানো ঠিক হবে না।”

ওয়াপসা-বাংলাদেশের সভাপতি মসিউর রহমান বলেন, “গত বছর আমরা করছাড় ও টিডিএস, ডিডিএসটি হ্রাসের আবেদন করেছিলাম, যা পোল্ট্রি খাতের উৎপাদন বাড়াতে সহায়তা করবে। এই সুবিধাগুলো না দিলে উৎপাদনকারীরা উৎসাহ হারাবে এবং ফলশ্রুতিতে বাজারে ডিম ও মাংসের দাম বাড়বে।”

পোল্ট্রি শিল্পের বর্তমান অবস্থা ও সরকারের বাজেট বরাদ্দ

সরকার ২০২৫-২৬ অর্থবছরে কৃষি, খাদ্য, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাতে মোট ৩৯ হাজার ৬২০ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে, যা গত বছরের তুলনায় প্রায় ১,৩০০ কোটি টাকা বেশি। এর মধ্যে পোল্ট্রি খাতেও উন্নয়ন ও বিনিয়োগের জন্য আলাদা বরাদ্দ রয়েছে। তবে কর বৃদ্ধির কারণে পোল্ট্রি শিল্পের প্রতিষ্ঠানগুলো অতিরিক্ত চাপের মুখে পড়তে পারে বলে সংশ্লিষ্টরা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন।

পোল্ট্রি খাতে কর বৃদ্ধির পাশাপাশি যন্ত্রাংশ আমদানিতে করের বোঝা

উৎপাদনশীলতা বাড়াতে বিদেশ থেকে যন্ত্রাংশ আমদানিতে পোল্ট্রি উদ্যোক্তাদের ৬০ শতাংশ কর দিতে হয়, যা অত্যন্ত উচ্চ এবং অযৌক্তিক বলে দাবি তাদের। তারা সরকারের কাছে এই কর কমিয়ে সর্বোচ্চ ১ শতাংশ করার অনুরোধ জানিয়েছেন, যাতে উৎপাদন খরচ কমে এবং শিল্পের টেকসই উন্নয়ন সম্ভব হয়।

বাজারে প্রভাব ও ভোক্তার জন্য সম্ভাব্য সমস্যা

কর বৃদ্ধির কারণে ডিম ও মুরগির দাম বাড়লে তা দেশের নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারের জন্য বড় ধাক্কা হবে। কারণ পোল্ট্রি খাদ্য হিসেবে বাংলাদেশের মানুষের প্রধান প্রোটিনের উৎস। দাম বাড়লে ভোক্তারা সঠিক পুষ্টি গ্রহণ থেকে বঞ্চিত হবেন, যা দীর্ঘমেয়াদে জনস্বাস্থ্যেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।

সুপারিশ ও আশা

পোল্ট্রি খাত সংশ্লিষ্টরা সরকারের কাছে আবেদন জানিয়েছেন, কর হার এমনভাবে নির্ধারণ করতে যাতে খাতের উৎপাদন ও বিনিয়োগ প্রভাবিত না হয়। সহনীয় করের পাশাপাশি কাঁচামালের ওপর অগ্রিম আয়কর কমানো হলে শিল্প স্থিতিশীল থাকবে এবং ডিম-মুরগির দাম নিয়ন্ত্রণে থাকবে।

তাদের মতে, সরকারের উচিত পোল্ট্রি খাতের উন্নয়নকে উৎসাহিত করে কর প্রণালী এমনভাবে সাজানো, যা দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে এবং সাশ্রয়ী দামে পুষ্টিকর খাবার সরবরাহে সাহায্য করবে।

  • পোল্ট্রি খাতের কর বৃদ্ধি: টার্নওভার কর ০.৬% থেকে ১%, করপোরেট কর ১৫% থেকে ২৭.৫%
  • বরাদ্দ: কৃষি ও প্রাণিসম্পদ খাতে মোট বরাদ্দ ৩৯,৬২০ কোটি টাকা (আগের বছরের তুলনায় ১,৩০০ কোটি টাকা বৃদ্ধি)
  • কারণ: বাজেট থেকে বেশি রাজস্ব আদায়ের পরিকল্পনা
  • সমস্যা: উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি, দাম বৃদ্ধি, আমদানিতে উচ্চ কর
  • দাবি: সহনীয় কর হার, কাঁচামাল আমদানিতে কর হ্রাস

বাংলাদেশের পোল্ট্রি শিল্প দেশের অর্থনীতি ও খাদ্য নিরাপত্তার গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তাই সরকারের উচিত এই খাতকে কর বৃদ্ধির চাপ থেকে মুক্ত রেখে, আরও উন্নয়নের সুযোগ করে দেওয়া। পোল্ট্রি শিল্পের টেকসই উন্নয়ন না হলে ভবিষ্যতে দেশব্যাপী প্রোটিন সংকট ও খাদ্য মূল্যস্ফীতি দেখা দিতে পারে, যা জনজীবনের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

  • বিপিআইসিসি (Bangladesh Poultry Industry Chamber of Commerce)
  • ওয়াপসা-বাংলাদেশ (WAPSA Bangladesh)
  • বাংলাদেশ অর্থ মন্ত্রণালয় ও বাজেট প্রস্তাবনা
মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button