বিএসএফের গুলিতে নিহত ইব্রাহিমের লাশ এক সপ্তাহ পর ফেরত দিল ভারত

বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তবর্তী চুয়াডাঙ্গার দর্শনা এলাকায় ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফের গুলিতে নিহত বাংলাদেশের যুবক ইব্রাহিম বাবুর লাশ এক সপ্তাহের দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর শেষমেষ ভারত থেকে ফেরত এসেছে। ২ জুলাই গরুর জন্য ঘাস কাটতে গিয়ে সীমান্ত সংলগ্ন এলাকায় বিএসএফের গুলিতে প্রাণ হারানো এই যুবকের লাশ মঙ্গলবার রাতে পতাকা বৈঠকের মাধ্যমে বাংলাদেশি বিজিবি’র কাছে হস্তান্তর করা হয়।
ইব্রাহিমের মৃত্যু: সীমান্তে ঘটে যাওয়া মর্মান্তিক ঘটনা
ইব্রাহিম বাবু, যিনি দামুড়হুদার ঝাঁঝাডাঙ্গা গ্রামের মাদ্রাসাপাড়ার নূর ইসলামের ছেলে, ২ জুলাই দুপুরে সীমান্তের কাছে গরুর জন্য ঘাস কাটতে গিয়েছিলেন। তখনই ভারতের নদীয়া জেলার গেদে ক্যাম্পের বিএসএফ সীমান্তরক্ষীরা তাঁকে লক্ষ্য করে গুলি চালায়। গুলিবিদ্ধ ইব্রাহিম ঘটনাস্থলেই মারা যান। পরে তাঁর লাশ বিএসএফ সদস্যরা ওপারে নিয়ে যায়।
নূর ইসলাম, নিহতের পিতা, জানান, “আমার ছেলে নিরীহ ছিল, গরুর জন্য ঘাস কাটতে গিয়েছিল। গুলি করার কোন কারণ নেই।” ইব্রাহিমের মৃত্যুর ঘটনায় পরিবারে শোকের ছায়া নেমে এসেছে।
লাশ ফেরত দেওয়ার প্রক্রিয়া: পতাকা বৈঠকের মাধ্যমে হস্তান্তর
নিহতের পরিবারের আবেদনের প্রেক্ষিতে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) এবং ভারতের বিএসএফ কর্তৃপক্ষ যৌথভাবে লাশ ফেরত দেওয়ার জন্য একটি পতাকা বৈঠক আহ্বান করে। ৮ জুলাই রাত ৯টায় দর্শনা সীমান্তের ৭৬ নম্বর পিলারের কাছে এই বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
বৈঠকে বিজিবির চুয়াডাঙ্গা-৬ ব্যাটালিয়নের দর্শনা কোম্পানি কমান্ডার এবং বিএসএফের ৩২ ব্যাটালিয়নের গেদে কোম্পানি কমান্ড্যান্ট উপস্থিত ছিলেন। ভারতের নদীয়া জেলার কৃষ্ণনগর থানা পুলিশ পরে দর্শনা থানার পুলিশকে লাশ হস্তান্তর করে।
দর্শনা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শহিদ তিতুমীর জানান, “লাশটি সঠিকভাবে বুঝে নিয়ে আমরা নিহতের পরিবারের কাছে হস্তান্তর করেছি। তাদের দুঃখ ও যন্ত্রণার প্রতি আমরা গভীর সমবেদনা জানাচ্ছি।”
বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে নিরাপত্তা পরিস্থিতি এবং সীমান্তে নিহতের ঘটনা
বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে নিয়মিত সংঘর্ষ ও হতাহতের ঘটনা ঘটে আসছে। বিশেষ করে সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ ও বিজিবির মধ্যে চৌকস নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও নিরীহ মানুষ প্রায়ই গুলিবিদ্ধ হয়ে জীবন হারান। ২০২৫ সালের শুরু থেকে বিভিন্ন সময়ে এমন দুর্ঘটনার ঘটনা বেড়েছে।
বিজিবি সূত্রে জানা যায়, সীমান্ত এলাকা নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে আরও কঠোর করতে এবং নিরীহ মানুষের জীবন রক্ষা করতে দুই দেশের নিরাপত্তা বাহিনী মাঝে মাঝে যৌথ সভা ও পরামর্শ সভা করে থাকে।
নিহত ইব্রাহিম বাবুর পরিবারের আবেদন ও প্রশাসনের প্রতিশ্রুতি
ইব্রাহিমের পিতা নূর ইসলাম সরকারের কাছে দ্রুত সুষ্ঠু বিচার এবং এরকম হত্যাকাণ্ড রোধের জন্য কড়া পদক্ষেপ নেওয়ার অনুরোধ জানান। তিনি বলেন, “আমাদের মতো হতদরিদ্র পরিবারের ছেলে যেন এমন নির্মম মৃত্যুর মুখে না পড়ে, সে জন্য আমরা সরকারের কাছে বিচার চাই।”
চুয়াডাঙ্গা জেলার প্রশাসনিক কর্মকর্তারা ও বিজিবি কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, নিহতের ঘটনা নিয়ে তদন্ত চলছে এবং দোষীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এছাড়া সীমান্ত এলাকায় সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বিজিবি ও বিএসএফের মধ্যে আরও সমন্বয় বাড়ানো হবে।
সীমান্তের মানুষের দুর্ভোগ ও জীবনের ঝুঁকি
বাংলাদেশ-ভারতের সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোতে থাকা সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা অনেক কঠিন। অনেক সময় গরু-ছাগল চোরাচালানের অপকর্মের ছায়ায় নিরীহ মানুষ সীমান্ত এলাকায় নানা ঝুঁকি নিয়ে কাজ করে থাকেন। তাদের জন্য ঘাস কাটা, চাষাবাদ কিংবা বসবাস করাই বিপদসঙ্কুল হয়ে দাঁড়ায়।
নিরাপত্তা বাহিনীর দৃষ্টি আকর্ষণ করার পরও এখনও এমন ঘটনা ঘটছে, যা স্থানীয় মানুষের জীবনে অনিশ্চয়তা ও আতঙ্ক তৈরি করেছে। স্থানীয়রা বারবার দাবি জানাচ্ছেন, সীমান্তে নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরো কড়া ও মানবিক হওয়া উচিত।
আন্তর্জাতিক সীমান্ত আইন ও মানবাধিকার পরিপ্রেক্ষিত
ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে দীর্ঘ সময় ধরে সুষ্ঠু সীমান্ত সম্পর্ক বজায় রাখতে দুই দেশের সরকার নানা ধরনের সমঝোতা ও প্রোটোকল গ্রহণ করে আসছে। সীমান্তে হত্যাকাণ্ড, লাঠিচার্জ এবং গুলির ঘটনা নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য ‘পিটা’ (পিলার ইন স্পট অ্যাগ্রিমেন্ট) নামে চুক্তিও রয়েছে।
তবে বাস্তবে নিয়মিত এই চুক্তি মানা হয় কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়। সীমান্তে গুলি চালানোর ঘটনা মানবাধিকার লঙ্ঘন হিসেবেও বিবেচিত হয়। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোও মাঝে মাঝে এই বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে।
সমাধানের পথে পদক্ষেপ
- দুই দেশের সীমান্ত নিরাপত্তা বাহিনীর আরও ঘনিষ্ঠ সমন্বয় এবং নজরদারি
- সীমান্তবর্তী গ্রামের মানুষের জন্য নিরাপদ কর্মসংস্থান ও বিকল্প আয়সূত্রের সৃষ্টি
- সীমান্ত এলাকা থেকে গরু-ছাগল চোরাচালান বন্ধের কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ
- সীমান্তে গুলির ঘটনা রোধে কড়া নিয়ম ও শাস্তির ব্যবস্থা
- নিরীহ মানুষদের সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য দুই দেশের সরকারের সম্মিলিত প্রচেষ্টা
ইব্রাহিম বাবুর এই মর্মান্তিক মৃত্যু শুধু এক পরিবারের নয়, পুরো সীমান্তবর্তী এলাকার মানুষের জন্য গভীর ব্যথার। আশা করা যায়, সরকারের দ্রুত ব্যবস্থা ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সম্মান রেখে এমন ঘটনা আর পুনরাবৃত্তি হবে না।
সীমান্তের শান্তি, নিরাপত্তা এবং মানুষের অধিকার রক্ষায় আমাদের সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা জরুরি।