রাইড শেয়ারিং চালকদের শ্রমিক স্বীকৃতির পথে বাংলাদেশ

দেশে দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে ওঠা রাইড শেয়ারিং খাতে কর্মরত চালকদের শ্রমিক হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার সুপারিশ করেছে শ্রম সংস্কার কমিশন। কমিশনের মতে, এই খাতের চালকেরা শ্রমিক হিসেবেই কাজ করছেন, কিন্তু তাদের নেই কোনো ন্যায্য মজুরি, কর্মসংস্থান নিরাপত্তা কিংবা কোনো ধরনের শ্রমিক অধিকার। ফলে তাদের জীবন ও জীবিকা বর্তমানে চরম অনিশ্চয়তায় রয়ে গেছে।
প্রধান উপদেষ্টার কাছে প্রতিবেদন জমা
শ্রম সংস্কার কমিশন সম্প্রতি তাদের বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস-এর কাছে জমা দিয়েছে। প্রতিবেদনে রাইড শেয়ারিং চালকদের অধিকার নিশ্চিত করতে নীতিগত ও কাঠামোগত একাধিক সুপারিশ তুলে ধরা হয়েছে।
কমিশনের প্রস্তাবিত মূল সুপারিশগুলো
- রাইড শেয়ারিং চালকদের শ্রমিক স্বীকৃতি প্রদান।
- ন্যায্য মজুরি ও বিশেষ মজুরি কাঠামো নির্ধারণ।
- রাইড শেয়ারিং কোম্পানিগুলোর কমিশন হার যৌক্তিকভাবে কমানো।
- রাইড শেয়ারিং খাতে একটি নিয়ন্ত্রক সংস্থা গঠন।
- চালক ও যাত্রী উভয়ের নিরাপত্তা নিশ্চিতে ২৪/৭ কল সেন্টার ও ডেটাবেজ ব্যবস্থাপনা।
- আন্তর্জাতিক মান অনুসারে শোভন কর্মপরিবেশ নিশ্চিত।
কমিশনের মতে, বহুজাতিক ও স্থানীয় রাইড শেয়ারিং কোম্পানিগুলোকে আন্তর্জাতিক শ্রম মান অনুযায়ী দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করতে হবে।
গিগ অর্থনীতি ও প্ল্যাটফর্মভিত্তিক কর্মসংস্থান নিয়ে উদ্বেগ
বিশ্বজুড়ে গিগ বা প্ল্যাটফর্মভিত্তিক অর্থনীতিতে শ্রমিক অধিকার নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। বাংলাদেশেও এখন এমন কর্মসংস্থানের পরিধি দ্রুত বাড়ছে—বিশেষ করে রাইড শেয়ারিং ও ফুড ডেলিভারি খাতে।
কমিশন বলছে, এসব খাতে নিয়োজিত শ্রমিকেরা ‘স্বনিযুক্ত’ হিসেবে গণ্য হলেও বাস্তবে তারা প্ল্যাটফর্ম কোম্পানির নির্ধারিত সময়সূচি, রেটিং, কমিশন ইত্যাদির ওপর নির্ভরশীল। তাই তাদের অধিকার রক্ষা করা না গেলে শোষণের মাত্রা বাড়তে পারে।
বাংলাদেশে রাইড শেয়ারিং খাতের বর্তমান চিত্র
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)-এর তথ্যানুসারে বর্তমানে দেশি-বিদেশি ১৫টি রাইড শেয়ারিং কোম্পানি বাংলাদেশে কার্যক্রম পরিচালনা করছে। তবে বাজারের প্রায় পুরো নিয়ন্ত্রণ রয়েছে মাত্র তিনটি কোম্পানির হাতে।
যদিও চালকদের সঠিক সংখ্যা পাওয়া যায় না, তবে খাত–সংশ্লিষ্টদের ধারণা, এই সংখ্যাটি লাখের কাছাকাছি।
যাত্রী ও চালকের অভিযোগ, কোম্পানির দায়
রাইড শেয়ারিং চালক ও যাত্রীদের মধ্যে সবচেয়ে বড় অভিযোগগুলো হলো:
- চালকেরা অ্যাপের বাইরে গিয়ে সরাসরি দর কষাকষি করেন
- বেশি কমিশন নেওয়ায় চালকেরা ন্যায্য আয় পান না
- খ্যাপে নেওয়া ভাড়া অনেক সময় অ্যাপের চেয়ে অনেক বেশি
- যাত্রীদের কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে যেতে অনীহা
- রাস্তায় যত্রতত্র বাইক পার্কিং এবং ফুটপাতে চালানো
এই সেবাকে নিয়ন্ত্রণে আনতে সরকার ২০১৭ সালে ‘রাইড শেয়ারিং সার্ভিস নীতিমালা’ প্রণয়ন করলেও এর কার্যকর প্রয়োগ নেই বলে অভিযোগ রয়েছে।
নিয়ন্ত্রক সংস্থা প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তা
কমিশনের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, রাইড শেয়ারিং খাতের উন্নয়নের জন্য একটি স্বতন্ত্র নিয়ন্ত্রক সংস্থা গঠন জরুরি, যা হবে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার আওতায়। এই সংস্থার দায়িত্ব হবে:
- চালক ও যাত্রীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা
- অভিযোগ নিষ্পত্তির ব্যবস্থা করা
- কমিশন নীতিমালা নির্ধারণ
- কর্মপরিবেশ ও শ্রম অধিকার সংরক্ষণ
আউটসোর্সিং নিয়োগ বন্ধের সুপারিশ
শুধু রাইড শেয়ারিং নয়, শ্রম সংস্কার কমিশন সরকারি, আধা-সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে নিয়োগ বন্ধ করারও সুপারিশ করেছে।
কমিশনের মতে, স্থায়ী জনবল কাঠামো হালনাগাদ করে সরাসরি নিয়োগ দিলে শ্রমিকদের অধিকতর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।
আউটসোর্সিং শ্রমিকদের জন্য আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ:
- দীর্ঘ সময় ধরে কর্মরতদের জন্য শ্রম আইন অনুযায়ী অধিকার ও সুরক্ষা নিশ্চিত করা
- বিনা কারণে চাকরিচ্যুতি বন্ধ করা
- প্রকল্প শেষে যোগ্যদের স্থায়ী নিয়োগে অগ্রাধিকার দেওয়া
- সিবিএ নির্বাচনে ভোটাধিকার ও সংগঠিত হওয়ার অধিকার
- অভিযোগ নিষ্পত্তির নিরপেক্ষ ও কার্যকর ব্যবস্থা
শ্রমনীতিতে যুগান্তকারী পরিবর্তনের ইঙ্গিত
শ্রম সংস্কার কমিশনের এই সুপারিশসমূহ বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশের রাইড শেয়ারিং ও গিগ অর্থনীতিভিত্তিক কর্মসংস্থানে একটি নতুন ধারা সূচিত হবে। এতে শুধু শ্রমিকের অধিকার সংরক্ষিত হবে না, বরং সেবা মান, যাত্রী নিরাপত্তা এবং খাতটির দীর্ঘমেয়াদি স্থায়িত্ব নিশ্চিত হবে।
একইসাথে, আউটসোর্সিং বন্ধ করে সরকারি চাকরিতে দীর্ঘদিন কাজ করা শ্রমিকদের স্থায়ী নিয়োগের ব্যবস্থা করলে সামাজিক নিরাপত্তা বলয় আরও শক্তিশালী হবে।