বিশ্ববাজারে সোনার দাম ৩,৭০০ ডলারে উঠতে পারে: গোল্ডম্যান স্যাক্সের পূর্বাভাস

বিশ্ববাজারে আবারও নজরকাড়া উর্ধ্বমুখী ধারা দেখা দিচ্ছে সোনার দামে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রভাবশালী বিনিয়োগ ব্যাংক গোল্ডম্যান স্যাক্স সম্প্রতি জানিয়েছে, ২০২৫ সালের শেষ নাগাদ প্রতি আউন্স সোনার দাম ৩,৭০০ ডলারে পৌঁছাতে পারে। বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা, কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর চাহিদা এবং ইটিএফ বিনিয়োগ বৃদ্ধিই এই সম্ভাবনার পেছনে মূল চালিকা শক্তি বলে মনে করছে প্রতিষ্ঠানটি।
আগের পূর্বাভাস থেকে আরও বাড়ল লক্ষ্যমাত্রা
গোল্ডম্যান স্যাক্স পূর্বে সোনার দাম আউন্সপ্রতি ৩,৩০০ ডলার পর্যন্ত উঠবে বলে পূর্বাভাস দিয়েছিল। কিন্তু নতুন বিশ্লেষণে তারা বলছে, সোনার দাম এখন ৩,৬৫০ থেকে ৩,৯৫০ ডলারের মধ্যে ওঠানামা করতে পারে। আর বছর শেষে এটি গড়ে ৩,৭০০ ডলার পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে।
রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, মন্দা দেখা দিলে সোনার দাম আরও বেড়ে আউন্সপ্রতি ৩,৮৮০ ডলার পর্যন্ত উঠতে পারে। এই মূল্য হবে ইতিহাসে অন্যতম সর্বোচ্চ।
কেন বাড়ছে সোনার দাম?
গোল্ডম্যান স্যাক্স জানিয়েছে, কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণের কারণে সোনার চাহিদা ও মূল্য বেড়েই চলেছে:
- কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর রিজার্ভ বৃদ্ধি: ২০২৪ সালে টানা তৃতীয় বছরের মতো বিশ্বের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো ১,০০০ টনের বেশি সোনা কিনেছে।
- ইটিএফ বিনিয়োগ বাড়ছে: বিনিয়োগকারীরা নিরাপদ সম্পদ হিসেবে সোনাভিত্তিক এক্সচেঞ্জ ট্রেডেড ফান্ড (ETF)-এ বিনিয়োগ বাড়াচ্ছে।
- নীতিগত অনিশ্চয়তা: যুক্তরাষ্ট্রে মুদ্রানীতির অনিশ্চয়তা, ট্রেড টেনশন এবং ভূরাজনৈতিক অস্থিরতা সোনাকে আরও নিরাপদ আশ্রয় হিসেবে তুলে ধরছে।
- ডোনাল্ড ট্রাম্পের শুল্কনীতি: মার্কিন নির্বাচনের প্রেক্ষাপটে ট্রাম্পের প্রতিশ্রুত নতুন শুল্ক নীতির সম্ভাবনা বিশ্ববাণিজ্যে অনিশ্চয়তা তৈরি করছে, যার সরাসরি প্রভাব পড়ছে সোনার দামে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর চাহিদা রেকর্ড পরিমাণে
ওয়ার্ল্ড গোল্ড কাউন্সিলের তথ্যমতে, ২০২৪ সালে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ১,০৩৭ টন সোনা কিনেছে, যা ছিল টানা তৃতীয় বছর ১,০০০ টনের বেশি কেনার ঘটনা।
২০২৫ সালেও এই ধারা অব্যাহত থাকবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। গোল্ডম্যান স্যাক্স জানিয়েছে, চলতি বছরে প্রতি মাসে গড়ে ৮০ মেট্রিক টন সোনা কিনতে পারে বিশ্বব্যাপী কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো। যা ২০২৪ সালের গড় ৭০ টনের চেয়েও বেশি।
সবচেয়ে উল্লেখযোগ্যভাবে, পোল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংক একাই কিনেছে ৯০ টন সোনা, যা অন্যান্য ইউরোপীয় দেশের তুলনায় অনেক বেশি।
ইটিএফে বিনিয়োগ কি সোনার দামকে আরও উর্ধ্বমুখী করবে?
গোল্ডম্যান স্যাক্স মনে করছে, বিশ্ব অর্থনীতিতে অনিশ্চয়তা যত দীর্ঘায়িত হবে, সোনাভিত্তিক ETF–এর প্রতি আগ্রহও তত বাড়বে। তবে যদি পরিস্থিতির স্থিতিশীলতা ফিরে আসে, বিশেষ করে মুদ্রানীতির পূর্বাভাস স্পষ্ট হয়, তাহলে ETF বিনিয়োগের গতি কিছুটা কমে যেতে পারে।
সেই ক্ষেত্রে সোনার দাম ৩,৫৫০ ডলারে গিয়ে থেমে যেতে পারে বলে উল্লেখ করেছে গোল্ডম্যান।
বিশ্ববাজারে এখন কত?
গোল্ড প্রাইস ডট অর্গ-এর সর্বশেষ তথ্যানুসারে, ১৯ এপ্রিল ২০২৫ তারিখে বিশ্ববাজারে সোনার দাম সামান্য কমেছে, যা এক ডলারেরও কম হ্রাস পেয়েছে। বর্তমানে প্রতি আউন্স সোনার দাম দাঁড়িয়েছে ৩,৩১৫ ডলার।
গত এক মাসে এই দাম বেড়েছে ২৭৯ ডলার এবং গত এক বছরে বেড়েছে ৯২৬ ডলার, যা এক বিশাল বৃদ্ধি বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।
সোনার ব্যবহার বাড়ছে বিশ্বজুড়ে
সোনার ব্যবহার এখন আর শুধুমাত্র গয়না কিংবা অলঙ্কারেই সীমাবদ্ধ নয়। আধুনিক অর্থনীতিতে এটি এখন ‘সেফ হ্যাভেন’ ইনভেস্টমেন্ট’ বা নিরাপদ বিনিয়োগ মাধ্যম হিসেবে বিবেচিত।
গত বছর (২০২৪)-এর ওয়ার্ল্ড গোল্ড কাউন্সিল এর বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্বজুড়ে মোট ৪,৯৭৪ টন সোনা লেনদেন হয়েছে, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য অংশ এসেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও ETF বিনিয়োগ থেকে।
বাংলাদেশের বাজারেও প্রভাব
বিশ্ববাজারের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বাংলাদেশের বাজারেও সোনার দাম ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে। বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতির (বাজুস) তথ্য অনুযায়ী, চলতি মাসেই দেশের বাজারে স্বর্ণের দাম ভরি প্রতি নতুন রেকর্ড ছুঁয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, আন্তর্জাতিক বাজারে সোনার দাম বাড়লে আমদানিনির্ভর বাংলাদেশের বাজারেও সরাসরি প্রভাব পড়ে। ফলে সাধারণ মানুষের জন্য স্বর্ণ কেনা ক্রমেই কঠিন হয়ে উঠছে।
বিনিয়োগকারীদের জন্য কী বার্তা?
গোল্ডম্যান স্যাক্সের এই বিশ্লেষণ স্পষ্ট করে দেয়— আগামী কয়েক মাসে সোনা একটি লাভজনক বিনিয়োগ মাধ্যম হতে পারে। বিশেষ করে মুদ্রাস্ফীতির আশঙ্কা, মন্দা এবং ভূরাজনৈতিক টানাপোড়েনের মধ্যে যারা নিরাপদ সম্পদ খুঁজছেন, তাঁদের জন্য সোনা হতে পারে অন্যতম ভরসার জায়গা।
তবে, বাজারে প্রবেশ করার আগে বিনিয়োগকারীদের জন্য পরামর্শ হচ্ছে:
- আন্তর্জাতিক বাজারের গতি নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করুন
- সোনাভিত্তিক ETF সম্পর্কে জেনে বিনিয়োগ করুন
- দামের শিখরে না গিয়ে অপেক্ষা করে সঠিক সময়ে সিদ্ধান্ত নিন
বিশ্ববাজারে সোনার দাম যে গতিতে বাড়ছে, তা শুধু বিনিয়োগকারীদের নয়, সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার ওপরও প্রভাব ফেলছে। গোল্ডম্যান স্যাক্সের এই পূর্বাভাস বিশ্ববাজারে স্বর্ণের ভবিষ্যত মূল্য নিয়ে নতুন এক মাত্রা যোগ করেছে। আর এই ধারাবাহিকতা চলতে থাকলে সোনার দাম ২০২৫ সালের শেষে ৩,৭০০ ডলার ছাড়িয়ে যাওয়াও খুব অস্বাভাবিক হবে না।