অর্থনীতি

যুক্তরাষ্ট্রে প্রবাসী আয়ে ৫% কর আরোপের প্রস্তাব: বাংলাদেশে কী প্রভাব ফেলবে?

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প অভিবাসীদের প্রেরিত প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্সের ওপর ৫ শতাংশ কর আরোপের প্রস্তাব দিয়েছেন। এই প্রস্তাব ইতোমধ্যে দেশটির হাউস বাজেট কমিটিতে ‘ওয়ান বিগ বিউটিফুল বিল অ্যাক্ট’ নামে একটি খসড়া আইনে পাস হয়েছে এবং এখন তা সিনেটে উত্থাপনের অপেক্ষায়। এই করের পরিণতিতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে পড়তে পারে বাংলাদেশসহ অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশগুলো।

এই খসড়া আইন অনুযায়ী, শুধুমাত্র মার্কিন নাগরিকদের পাঠানো অর্থ করমুক্ত থাকবে। গ্রিন কার্ডধারী, এইচ-১বি ভিসাধারী এবং অন্যান্য অভিবাসী যারা নিয়মিতভাবে তাদের নিজ দেশে অর্থ পাঠান, তারাও এই করের আওতায় পড়বেন। এর ফলে বাংলাদেশিদের যুক্তরাষ্ট্র থেকে পাঠানো রেমিট্যান্সেও ৫ শতাংশ কর বসবে।

বাংলাদেশের রেমিট্যান্সে যুক্তরাষ্ট্রের অবদান

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাম্প্রতিক তথ্য বলছে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশে এসেছে ৪২৭ কোটি ১০ লাখ মার্কিন ডলার, যার পরিমাণ বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৫২ হাজার ২৬ কোটি টাকা (১ ডলার = ১২২ টাকা ধরে)। শুধু এপ্রিল মাসেই এসেছে ৩৩ কোটি ৭ লাখ ডলার।

যদি প্রস্তাবিত ৫% কর কার্যকর হয়, তাহলে এই বিপুল অঙ্কের প্রবাসী আয়ের ওপর কর বাবদ বছরে প্রায় ২১ দশমিক ৮৫ কোটি ডলার (২ হাজার ৬৬৫.৭ কোটি টাকা) হারাতে হতে পারে বাংলাদেশকে। এই রাজস্ব যুক্তরাষ্ট্রের কোষাগারে যাবে, কিন্তু এর বিরূপ প্রভাব পড়বে বাংলাদেশি অর্থনীতিতে, বিশেষ করে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে।

রেমিট্যান্স হ্রাসে সম্ভাব্য প্রভাব ও শঙ্কা

বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের একটি বড় উৎস হলো প্রবাসী আয়। এই আয় আসে কোনও দায় ছাড়াই, অর্থাৎ সরকারের এ অর্থের বিপরীতে কোনো বৈদেশিক ঋণ বা রপ্তানি খরচ নেই। কিন্তু রপ্তানি আয় যেমন পোশাক খাতে হয়, সেক্ষেত্রে কাঁচামাল আমদানি, উৎপাদন ব্যয় ইত্যাদিতে বৈদেশিক মুদ্রা খরচ হয়।

তাই প্রবাসী আয়ের ওপর কর বসানো হলে একদিকে যেমন ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে প্রবাসী আয় পাঠানো কমে যাবে, অন্যদিকে বেড়ে যাবে হুন্ডি বা অনানুষ্ঠানিক উপায়ে অর্থ প্রেরণ। এতে সরকারের রাজস্ব ক্ষতি হবে, বৈধ পথে রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে যাবে এবং ডলারের রিজার্ভে চাপ বাড়বে।

বিশ্বজুড়ে রেমিট্যান্স প্রবাহের বর্তমান চিত্র

বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে বিশ্বের নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ রেমিট্যান্স এসেছে ভারতে—১২৯ বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশ রয়েছে ষষ্ঠ অবস্থানে, মোট আয় ২৬.৬ বিলিয়ন ডলার। এই আয়ের বড় একটি অংশ আসে মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ এবং যুক্তরাষ্ট্র থেকে।

বিশ্বজুড়ে রেমিট্যান্স পাঠানোর পদ্ধতিতে সাম্প্রতিক সময়ে পরিবর্তন এসেছে। বড় বড় আর্থিক প্রতিষ্ঠান যেমন ওয়েস্টার্ন ইউনিয়ন, মানিগ্রাম এখন অ্যাগ্রিগেটেড মডেলে অর্থ সংগ্রহ করে পাঠিয়ে থাকে। তারা একাধিক উৎস থেকে অর্থ সংগ্রহ করে নির্দিষ্ট দেশের রেমিট্যান্স হিসেবে পাঠায়। এতে বৈধতা ও ট্র্যাকিং সহজ হলেও এখন নতুন কর আরোপে এই প্রক্রিয়াও বাধাগ্রস্ত হতে পারে।

যুক্তরাষ্ট্রে কর আরোপের পেছনের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট

প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তার প্রথম মেয়াদেও অভিবাসনবিরোধী বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। নতুন করে দ্বিতীয় মেয়াদে দায়িত্ব নেওয়ার পর আবারও অভিবাসীদের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা হ্রাস করার লক্ষ্যে নীতি গ্রহণ করছেন। তার মতে, অভিবাসীরা যুক্তরাষ্ট্রের সম্পদ দেশের বাইরে পাঠিয়ে দিচ্ছে, যা দেশটির অর্থনীতির জন্য হুমকি।

এই চিন্তার ভিত্তিতে ‘ওয়ান বিগ বিউটিফুল বিল অ্যাক্ট’-এ প্রবাসী আয়কে ‘ট্যাক্সেবল ইনকাম’ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে, যদিও এটি আন্তর্জাতিকভাবে সমালোচিত হচ্ছে। কারণ উন্নয়নশীল দেশগুলোর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক সহযোগিতার এই একটি বড় মাধ্যম হচ্ছে প্রবাসী আয়।

বাংলাদেশ সরকারের করণীয় ও প্রস্তুতি

যদি এই বিল সিনেটেও পাস হয়ে আইনে পরিণত হয়, তবে তাৎক্ষণিকভাবে বাংলাদেশ সরকারকে কৌশলগত পদক্ষেপ নিতে হবে। কিছু সম্ভাব্য প্রস্তুতির মধ্যে রয়েছে:

  1. হুন্ডি প্রতিরোধে বিশেষ উদ্যোগ: অনানুষ্ঠানিক পথ বন্ধে কড়া মনিটরিং ও প্রচারণা বাড়াতে হবে।
  2. বিকল্প দেশ বা অঞ্চল থেকে রেমিট্যান্স উৎস বৃদ্ধি: মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ বা মালয়েশিয়া থেকে আয় বৃদ্ধির উদ্যোগ নিতে হবে।
  3. প্রবাসীদের উদ্বুদ্ধ করা: সরকারিভাবে প্রণোদনা বা কর ছাড় দিয়ে বৈধ পথে অর্থ পাঠাতে উৎসাহিত করা।
  4. যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কূটনৈতিক আলোচনা: কর ছাড় সংক্রান্ত আলোচনার জন্য কূটনৈতিক চ্যানেলে তৎপরতা চালানো।

যুক্তরাষ্ট্রে প্রবাসী আয়ের ওপর ৫ শতাংশ কর আরোপের প্রস্তাব শুধু বাংলাদেশের নয়, বরং বিশ্বের অসংখ্য উন্নয়নশীল দেশের অর্থনীতির জন্য হুমকিস্বরূপ। যদি এই আইন বাস্তবায়িত হয়, তাহলে বাংলাদেশ সরকারের জন্য এটি একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে। কারণ দেশের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ, ব্যাংকিং চ্যানেলের রেমিট্যান্স এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার ওপর এর সরাসরি প্রভাব পড়বে। এখন সময় এসেছে সরকারের নীতি নির্ধারকদের দ্রুত, কৌশলী এবং প্রবাসীবান্ধব পদক্ষেপ নেওয়ার।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button