অর্থনীতি

ডলার ধরে না রাখার আহ্বান গভর্নরের

বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর প্রবাসীদের ডলার ধরে না রেখে রেমিট্যান্স পাঠানোর আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, বাজারভিত্তিক বিনিময় হারে ডলারের দর স্থিতিশীল থাকবে। জেনে নিন গোলটেবিল আলোচনার গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য ও বিশ্লেষণ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর দেশের প্রবাসীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন, ডলারের মূল্য আরও বাড়বে—এই আশায় মুদ্রা ধরে না রেখে রেমিট্যান্স দ্রুত দেশে পাঠাতে। তিনি স্পষ্টভাবে জানান, দেশের মুদ্রানীতিতে বড় পরিবর্তন এনে বিনিময় হারকে বাজারভিত্তিক করা হয়েছে, যা ডলারের দামে স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করবে।

এই মন্তব্য গভর্নর করেন রাজধানীর গুলশানের ওয়েস্টিন হোটেলে আয়োজিত এক গোলটেবিল আলোচনায়। ‘বাজারভিত্তিক বিনিময় হারের প্রয়োগ ও প্রভাব’ শীর্ষক এ আলোচনার আয়োজন করে দেশের শীর্ষ অর্থনৈতিক দৈনিক বণিক বার্তা

গভর্নরের স্পষ্ট বার্তা: “ডলার ধরে রাখা ক্ষতির ঝুঁকি”

আলোচনায় গভর্নর বলেন,

“দাম বাড়বে ভেবে ডলার ধরে রাখা বিপদজনক হতে পারে। কারণ বাজারের ভিত্তিতে হার ঠিক হলেও ডলারের মূল্য হঠাৎ করে আর বাড়বে না।”

তিনি বলেন, আইএমএফ ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর পরামর্শ অনুযায়ী দীর্ঘদিন পর বাংলাদেশ বাজারভিত্তিক বিনিময় হার বাস্তবায়ন করেছে। আগে অনেকেই আশঙ্কা করেছিলেন সরকার এটি বাস্তবায়ন করতে পারবে না। তবে বর্তমান সরকার সেই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেছে এবং সফলভাবে তা বাস্তবায়ন করেছে বলেই জানান তিনি।

মূল্যস্ফীতি নিয়ে আশাবাদী বাংলাদেশ ব্যাংক

মুদ্রানীতির একটি বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে মূল্যস্ফীতি। এ প্রসঙ্গে গভর্নর বলেন,

“আমাদের এখন মূল লক্ষ্য হচ্ছে মূল্যস্ফীতি ৩ থেকে ৪ শতাংশে নামিয়ে আনা। আশা করছি আগস্টের মধ্যে এটি ৭ শতাংশে নামবে এবং বছরের শেষে ৫ শতাংশের মধ্যে চলে আসবে।”

এ সময় তিনি আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যমূল্যের নিম্নমুখী প্রবণতাকে বাংলাদেশের জন্য একটি বড় সুযোগ হিসেবে উল্লেখ করেন। একই সঙ্গে বিলাসী পণ্যের ওপর নিষেধাজ্ঞা নয়, বরং কর বৃদ্ধির পক্ষেও মত দেন তিনি।

“যার সামর্থ্য আছে, সে বিলাসী পণ্য কিনুক। নিষেধাজ্ঞা নয়, করের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ হোক।”

অর্থ পাচার: রাজনৈতিক অর্থনীতির সংস্কার জরুরি

বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচার রোধে রাজনৈতিক অর্থনীতির সংস্কার প্রয়োজন বলে জানান গভর্নর।
তিনি বলেন,

“অনেকে দেশের বাইরে শত শত কোটি ডলার রেখে দিচ্ছেন। তারা মনে করেন, দেশে অর্থ নিরাপদ নয়। আমাদের অর্থনৈতিক ব্যবস্থার নিরাপত্তা এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিয়ে ভাবতে হবে।”

অংশগ্রহণকারীদের বিশ্লেষণ: বাজারভিত্তিক হারে বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ

গোলটেবিল আলোচনায় অন্যান্য বক্তারাও গভর্নরের মতকে সমর্থন করেন এবং নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেন।

ফাহমিদা খাতুন, নির্বাহী পরিচালক, সিপিডি:

“অর্থনীতির যৌক্তিক দিক বিবেচনায় আমাদের বাজারভিত্তিক বিনিময় হারের দিকেই যেতে হতো। বর্তমান সময়টি এই পরিবর্তনের জন্য উপযুক্ত।”

সৈয়দ আবু নাসের বখতিয়ার আহমেদ, চেয়ারম্যান, অগ্রণী ব্যাংক:

“আমরা অনেক বিলাসী পণ্য বিদেশ থেকে আমদানি করি, যা কমালে ডলারের চাহিদাও কমবে।”

মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম, চেয়ারম্যান, জিপিএইচ ইস্পাত:

“অর্থনীতিতে একটি বড় ধরনের সংস্কার দরকার ছিল, যা এই বাজারভিত্তিক বিনিময় হার বাস্তবায়নের মাধ্যমে হয়েছে।”

এম মাসরুর রিয়াজ, চেয়ারম্যান, পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশ:

“২০১৮–১৯ সাল থেকে বিনিময় হারে কৃত্রিম চাপ প্রয়োগ করা হচ্ছিল। এখন সেই চাপ থেকে মুক্ত হয়ে বাস্তব অবস্থায় ফিরেছে দেশ।”

সৈয়দ মাহবুবুর রহমান, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক:

তিনি বলেন, দীর্ঘদিন পর বিনিময় হার বাস্তবায়নের সাহসিক সিদ্ধান্ত দেশের বৈদেশিক লেনদেনে আস্থার সংকট কাটাবে।

অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন প্রাণ–আরএফএল গ্রুপের ফাইন্যান্স ডিরেক্টর উজমা চৌধুরী, ফেয়ার গ্রুপের চেয়ারম্যান রুহুল আলম আল মাহবুব, মাস্টারকার্ডের কান্ট্রি ম্যানেজার সৈয়দ মোহাম্মদ কামাল এবং ওয়েস্টার্ন ইউনিয়নের রিজিওনাল অপারেশন ম্যানেজার শিহাবুল হাসান প্রমুখ।

সারসংক্ষেপ:

বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য বাজারভিত্তিক বিনিময় হার একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। প্রবাসীদের উদ্দেশে গভর্নরের বার্তা স্পষ্ট—ডলার ধরে রাখার দিন শেষ। রেমিট্যান্স পাঠাতে হবে এখনই। একই সঙ্গে অর্থ পাচার, মূল্যস্ফীতি ও বিলাসী পণ্যের নিয়ন্ত্রণে বাস্তবমুখী পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান উঠে এসেছে আলোচনায়।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button