সাটুরিয়ায় ইটভাটার গরম গ্যাসে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের ক্ষতিপূরণ প্রদান

মানিকগঞ্জের সাটুরিয়া উপজেলার ফুকুরহাটি ইউনিয়নের কান্দাপাড়া গ্রামে যমুনা ব্রিকস ফিল্ড নামের একটি ইটভাটার গরম গ্যাসে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন ৩৬ জন কৃষক। তাদের তিন ফসলি জমিতে ধানসহ বিভিন্ন ফসল ব্যাপকভাবে নষ্ট হয়। এই ঘটনার পর প্রশাসনের হস্তক্ষেপে অভিযুক্ত ইটভাটার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয় এবং অবশেষে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের মধ্যে এক লাখ ৯৪ হাজার ৯৭৮ টাকা ক্ষতিপূরণ বিতরণ করা হয়েছে।
কী ঘটেছিল মূলত?
সাটুরিয়ার ফুকুরহাটি ইউনিয়নের কান্দাপাড়া গ্রামে অবস্থিত মেসার্স যমুনা ব্রিকস ফিল্ড দীর্ঘদিন ধরে কার্যক্রম চালিয়ে আসছিল। এই ইটভাটার গরম গ্যাস ও কালো ধোঁয়া আশপাশের তিন ফসলি কৃষিজমির ফসলের মারাত্মক ক্ষতি করে। প্রায় এক কিলোমিটার এলাকাজুড়ে ধান, সবজি, সরিষা, কুমড়া, শাকসবজি ইত্যাদি ফসল পুড়ে যায় বা বিকল হয়ে পড়ে।
স্থানীয় কৃষকদের অভিযোগ, ইটভাটাটি দীর্ঘদিন ধরে পরিবেশ বিধিমালা না মেনে কার্যক্রম চালিয়ে আসছিল। তারা বারবার অভিযোগ করলেও কর্তৃপক্ষ নজর দেয়নি। একপর্যায়ে কৃষকেরা বাধ্য হয়ে সাংবাদিকদের কাছে যান এবং গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ হলে বিষয়টি প্রশাসনের নজরে আসে।
প্রশাসনের অভিযানে জরিমানা ও বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন
গত ২০ মে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. ইকবাল হোসেন নেতৃত্বে একটি মোবাইল কোর্ট অভিযানে যায় যমুনা ব্রিকস ফিল্ডে। অভিযানে পরিবেশ বিধি লঙ্ঘনের দায়ে এক লাখ টাকা জরিমানা আদায় করা হয় এবং তাৎক্ষণিকভাবে বন্ধ করে দেওয়া হয় ইটভাটার সকল কার্যক্রম। পাশাপাশি কেটে দেওয়া হয় বিদ্যুৎ সংযোগ, যাতে ভাটাটি পুনরায় চালু করতে না পারে।
এই পদক্ষেপের পর এলাকায় স্বস্তি ফিরে আসে এবং ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকেরা ক্ষতিপূরণের দাবিতে ইউএনও কার্যালয়ের সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন।
অবশেষে কৃষকদের হাতে ক্ষতিপূরণের টাকা
রবিবার (১ জুন) দুপুরে সাটুরিয়া উপজেলা কৃষি দপ্তর প্রাঙ্গণে আনুষ্ঠানিকভাবে ৩৬ জন ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকের হাতে ক্ষতিপূরণ বাবদ এক লাখ ৯৪ হাজার ৯৭৮ টাকা বিতরণ করা হয়। এ সময় উপস্থিত ছিলেন উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আব্দুল্লাহ আল মামুন। তিনি বলেন, “আমরা জেলা প্রশাসনের নির্দেশনায় ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের তালিকা তৈরি করে ক্ষতিপূরণ নিশ্চিত করেছি। কৃষকদের পাশে প্রশাসন সব সময় রয়েছে।”
কৃষকদের প্রতিক্রিয়া: স্বস্তি ও কৃতজ্ঞতা
ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক মো. শামীম বলেন, “আমার ধানের জমি পুরোটাই নষ্ট হয়ে গেছে। প্রথমে খুব অসহায় বোধ করছিলাম। কিন্তু সাংবাদিক ও প্রশাসনের সহায়তায় আজ টাকা পেয়েছি। কৃতজ্ঞতা জানাই সবার প্রতি।”
আরেক কৃষক সাহাবুদ্দিন বলেন, “আমরা চাই ভবিষ্যতে আর কোনো ভাটা যেন এভাবে কৃষিজমির ক্ষতি না করে। নিয়ম মেনে যেন ভাটা পরিচালিত হয়, প্রশাসন যেন নজর রাখে।”
ইটভাটার মালিকের বক্তব্য
ভাটার মালিক আবুল কালাম বলেন, “আমরা ভুল বুঝতে পেরেছি। ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণের টাকাও নির্ধারিত সময়েই দেওয়া হয়েছে। আগামীতে ভাটার কার্যক্রম চালুর আগে পরিবেশ অধিদপ্তরের অনুমতি নিয়ে যথাযথ নিয়ম মেনে কাজ করব।”
ইউএনও’র সোজা বার্তা: নিয়মভঙ্গ করলে ছাড় নেই
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. ইকবাল হোসেন বলেন, “আমরা লিখিত অভিযোগ পাওয়ার পরপরই ব্যবস্থা নিয়েছি। ভবিষ্যতে কেউ যদি পরিবেশবিধি না মেনে ইটভাটা চালায়, তাদের বিরুদ্ধেও একইভাবে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কৃষকের ফসল যেন নিরাপদ থাকে, সেটাই আমাদের মূল লক্ষ্য।”
তিনি আরও বলেন, “সাটুরিয়ার কৃষিভিত্তিক অর্থনীতিকে সুরক্ষা দিতে ইটভাটার অনুমোদন ও কার্যক্রম নিয়ম মেনে হচ্ছে কি না, তা মনিটরিং করা হবে।”
পরিবেশ ও কৃষি: দুইয়ের ভারসাম্য প্রয়োজন
বাংলাদেশে ইটভাটা শিল্প একদিকে যেমন অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখছে, অন্যদিকে পরিবেশ ও কৃষিজমির ওপর এর বিরূপ প্রভাবও উদ্বেগজনক। পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, অনেক ইটভাটা এখনও পরিবেশ ছাড়পত্র ছাড়াই চলছে। এসব ইটভাটার তাপ, ধোঁয়া ও ছাই আশপাশের কৃষিজমির জন্য ভয়াবহ হুমকি।
পরিবেশবাদীদের মতে, ইটভাটাগুলো যদি জ্বালানি হিসেবে কাঠের পরিবর্তে আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর জ্বালানি ব্যবহার করে এবং নির্দিষ্ট দূরত্বে গড়ে ওঠে, তাহলে এ ক্ষতির পরিমাণ অনেকাংশে কমানো সম্ভব।
কৃষকদের দাবি: দীর্ঘমেয়াদি সমাধান দরকার
কান্দাপাড়া গ্রামের ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকেরা বলেন, এ ধরনের ঘটনা যাতে ভবিষ্যতে না ঘটে, তার জন্য একটি স্থায়ী নজরদারি ব্যবস্থা প্রয়োজন। তারা চান—প্রশাসন প্রতিটি মৌসুমে ভাটাগুলোর কার্যক্রম পরিদর্শন করুক এবং অনুমোদন ছাড়া কোনো ভাটা যেন চালু না থাকে।
সাটুরিয়ার যমুনা ব্রিকস ফিল্ডের ঘটনায় প্রশাসনের সময়োপযোগী ও কার্যকর পদক্ষেপ যেমন প্রশংসনীয়, তেমনি এই ঘটনা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় যে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ইটভাটার কারণে কৃষিজমি কীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কৃষকদের জীবিকা সুরক্ষায় আরও কঠোর নীতিমালা ও বাস্তবায়নের প্রয়োজন রয়েছে। এ ঘটনার দ্রুত নিষ্পত্তি স্থানীয় প্রশাসনের সচেতনতা এবং সাংবাদিকদের দায়িত্বশীল ভূমিকার একটি সফল উদাহরণ।