কলম-বিরতিতে কার্যক্রম ব্যাহত, ফের কর্মসূচি দিলো এনবিআরের কর্মকর্তারা

জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) বিলুপ্ত করে এটিকে দুটি ভিন্ন সত্তায় রূপান্তরের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন এনবিআরের কর্মকর্তারা। সরকারের এই পদক্ষেপের বিরোধিতা করে গতকাল শনিবার (১৭ মে) শেষ হয়েছে তাদের তিন দিনের কলম-বিরতি কর্মসূচি। তবে এই অচলাবস্থা নিরসনে সরকারের সঙ্গে আলোচনার টেবিলে বসতে তারা সম্পূর্ণ প্রস্তুত বলে জানিয়েছেন আন্দোলনরত কর্মকর্তারা।
শনিবার রাজধানীর একটি ভেন্যুতে ‘এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদ’-এর ব্যানারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে কর্মকর্তারা তাদের পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা করেন এবং সরকারের প্রতি সংলাপের আহ্বান জানান। এই সংকটের দ্রুত সমাধানে প্রধান উপদেষ্টার হস্তক্ষেপ কামনা করেন তারা।
সংবাদ সম্মেলনে এনবিআর কাস্টমসের যুগ্ম কমিশনার নিপুণ চাকমা আন্দোলনকারীদের পক্ষ থেকে তাদের অবস্থান স্পষ্ট করেন। তিনি বলেন, “সংলাপের দরজা সব সময় খোলা ছিল এবং আমরা বিশ্বাস করি এটি খোলা থাকবে। আমরা চাই এই সমস্যার একটি শান্তিপূর্ণ সমাধান হোক। প্রধান উপদেষ্টার প্রয়োজনীয় নির্দেশনা পেলেই আমরা সরকারের সঙ্গে আলোচনায় বসতে প্রস্তুত আছি।” তার এই বক্তব্য সরকারের প্রতি সংলাপের একটি জোরালো বার্তা বহন করে, যা চলমান অচলাবস্থা নিরসনে একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ হতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
আন্দোলনকারীদের মূল অভিযোগ হলো, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে পুনর্গঠনের ক্ষেত্রে এনবিআর সংস্কার কমিটির সুপারিশগুলোকে সম্পূর্ণরূপে উপেক্ষা করা হয়েছে। সরকার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তাতে এনবিআরকে ‘রাজস্ব নীতি বিভাগ’ এবং ‘রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগ’—এই দুটি আলাদা সত্তায় ভাগ করা হবে। আন্দোলনকারীরা মনে করেন, এই বিভাজন এনবিআর সংস্কার কমিটির মূল সুপারিশের সঙ্গে সাংঘর্ষিক এবং এটি রাজস্ব প্রশাসনের কার্যকারিতা ও সমন্বয়ে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। তারা প্রশ্ন তোলেন, একটি স্বাধীন এবং বিশেষজ্ঞ কমিটির সুপারিশকে কেন পাশ কাটানো হলো এবং এই সিদ্ধান্তের নেপথ্যে কী কারণ রয়েছে?
তাদের মতে, এনবিআরকে এমনভাবে পুনর্গঠন করা উচিত যাতে রাজস্ব আদায় প্রক্রিয়া আরও শক্তিশালী হয়, কর ফাঁকি রোধ করা যায় এবং করদাতারা হয়রানি ছাড়াই সেবা পান। এনবিআর সংস্কার কমিটি এই লক্ষ্যগুলো অর্জনের জন্য সুনির্দিষ্ট প্রস্তাবনা তৈরি করেছিল বলে তারা দাবি করেন। কমিটির প্রতিবেদন প্রকাশ না করা এবং সেই অনুযায়ী পদক্ষেপ না নেওয়াটাও তাদের অসন্তোষের একটি অন্যতম কারণ। কর্মকর্তারা মনে করেন, কমিটির প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে সাধারণ জনগণ এবং সংশ্লিষ্ট অংশীজনরাও সংস্কার প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা সম্পর্কে জানতে পারতেন।
শনিবারের সংবাদ সম্মেলনে আন্দোলনকারীরা তাদের পরবর্তী পদক্ষেপ হিসেবে নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন। তারা জানান, চলমান আন্দোলনের অংশ হিসেবে আগামী রোববার (১৮ মে) সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৩টা পর্যন্ত মোট ছয় ঘণ্টার কলম-বিরতি কর্মসূচি পালন করা হবে। এই কর্মসূচি এনবিআরের সকল স্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অংশগ্রহণে পালিত হবে এবং এর ফলে রাজস্ব আদায়ের দৈনন্দিন কার্যক্রমে বিঘ্ন ঘটতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এই ধরনের কর্মসূচি কেবল কর্মকর্তাদের প্রতিবাদ নয়, এটি রাজস্ব সংগ্রহ এবং সরকারের আর্থিক ব্যবস্থাপনার ওপরও সরাসরি প্রভাব ফেলে। প্রতিটি কর্মঘণ্টা নষ্ট হওয়া মানেই নির্দিষ্ট পরিমাণের রাজস্ব আদায় পিছিয়ে যাওয়া, যা দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব ফেলতে পারে।
আন্দোলনকারীদের পক্ষ থেকে বেশ কয়েকটি প্রধান দাবি উত্থাপন করা হয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো—প্রস্তাবিত রাজস্ব অধ্যাদেশ বাতিল করা। তারা মনে করেন, এই অধ্যাদেশে এমন কিছু বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে যা রাজস্ব প্রশাসনের জন্য হিতকর নয় অথবা এর ফলে জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে। দ্বিতীয়ত, তারা এনবিআর সংস্কার কমিটির প্রতিবেদন দ্রুত প্রকাশ করার দাবি জানিয়েছেন। এই প্রতিবেদন জনসমক্ষে প্রকাশ পেলে কমিটির সুপারিশগুলো নিয়ে আলোচনা ও পর্যালোচনা করা সম্ভব হবে এবং ভবিষ্যতের সংস্কার পদক্ষেপ গ্রহণে এটি একটি ভিত্তি হিসেবে কাজ করবে। তৃতীয়ত এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দাবি হলো—রাজস্ব ব্যবস্থার ব্যাপক সংস্কারের লক্ষ্যে এনবিআরের কর্মকর্তা, ব্যবসায়ী সংগঠন, নাগরিক সমাজ এবং রাজনৈতিক নেতাসহ সকল অংশীজনের সঙ্গে আলোচনা করা। তারা বিশ্বাস করেন, একটি টেকসই এবং কার্যকর রাজস্ব ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য সকল পক্ষের মতামত ও অভিজ্ঞতা বিবেচনা করা অপরিহার্য। শুধুমাত্র সরকারের একতরফা সিদ্ধান্তে গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার সফল হতে পারে না।
এনবিআরের কর্মকর্তাদের এই আন্দোলন দেশের রাজস্ব ব্যবস্থাপনা নিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিতর্ক উস্কে দিয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে, রাজস্ব আদায় বাড়াতে এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠায় কী ধরনের সংস্কার প্রয়োজন? এনবিআরকে ভেঙে দুটি অংশে বিভক্ত করার সিদ্ধান্ত কি আসলেই কার্যকর হবে, নাকি এতে সমন্বয়ের অভাব দেখা দেবে? অন্যদিকে, এনবিআর সংস্কার কমিটির সুপারিশগুলো কেন বাস্তবায়ন করা হলো না এবং সেই প্রতিবেদন কেন অপ্রকাশিত রয়ে গেল, এ নিয়েও রয়েছে নানা প্রশ্ন।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এনবিআর বিলুপ্তির সিদ্ধান্ত এবং এর প্রতিবাদে কর্মকর্তাদের আন্দোলন দেশের রাজস্ব সম্প্রসারণ এবং সামষ্টিক অর্থনীতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। রাজস্ব আদায় ব্যাহত হলে সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড এবং জনকল্যাণমূলক প্রকল্পে অর্থায়নে সমস্যা দেখা দিতে পারে। এই অবস্থায় সরকার এবং আন্দোলনকারী কর্মকর্তাদের মধ্যে দ্রুত সংলাপের মাধ্যমে একটি সমঝোতায় পৌঁছানো অত্যন্ত জরুরি। উভয় পক্ষকে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ বজায় রেখে আলোচনা চালিয়ে যেতে হবে এবং একটি গ্রহণযোগ্য সমাধান বের করতে হবে যা দেশের স্বার্থ রক্ষা করবে।
আন্দোলনকারী কর্মকর্তারা স্পষ্ট করেছেন যে তারা সংলাপের জন্য প্রস্তুত। এখন সরকারের পক্ষ থেকে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের অপেক্ষা। প্রধান উপদেষ্টার নির্দেশনা এই অচলাবস্থা নিরসনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। সকল পক্ষের সম্মিলি