বুয়েটের ছাত্র থেকে যুক্তরাষ্ট্রের এনার্জি-এআই বিশেষজ্ঞ: বৈশ্বিক গবেষণা কমিটিতে স্থান পেলেন সৈয়দ বাহাউদ্দিন

বিদ্যুৎ বিভ্রাটের শৈশব অভিজ্ঞতা থেকে শুরু হয়েছিল তাঁর ‘এনার্জি’ নিয়ে ভাবনা। সেই ভাবনা এখন তাকে নিয়ে গেছে বিশ্বের অন্যতম মর্যাদাপূর্ণ গবেষণা কমিটিতে। বাংলাদেশের গর্ব, বুয়েটের প্রাক্তন ছাত্র, চট্টগ্রামের ছেলে ড. সৈয়দ বাহাউদ্দিন আলম এখন যুক্তরাষ্ট্রের ‘ন্যাশনাল একাডেমিস অব সায়েন্সেস, ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড মেডিসিন (NASEM)’–এর গুরুত্বপূর্ণ একটি বিশেষজ্ঞ কমিটির সদস্য।
যুক্তরাষ্ট্রের গবেষণা-পরিবেশে বাংলাদেশের মুখ
বর্তমানে বাহাউদ্দিন আলম যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব ইলিনয় অ্যাট আর্বানা-শ্যাম্পেইনের (UIUC) নিউক্লিয়ার, প্লাজমা অ্যান্ড রেডিওলজিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত। তার গবেষণার মূল বিষয় হলো নিউক্লিয়ার এনার্জি সিস্টেমে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI), ডিজিটাল টুইন এবং রিয়েল-টাইম পর্যবেক্ষণ প্রযুক্তির ব্যবহার।
এ বছর জানুয়ারিতে তিনি NASEM-এর বিশেষজ্ঞ কমিটিতে নিযুক্ত হন। এই কমিটি কাজ করছে ‘Foundation Models for Scientific Discovery and Innovation: Opportunities across the Department of Energy’ শীর্ষক একটি প্রকল্প নিয়ে, যা মার্কিন জ্বালানি দপ্তরের জন্য এআই প্রযুক্তি প্রয়োগের সম্ভাবনা যাচাই ও উন্নয়নের কাজ করছে।
এই কমিটিতে তার সহ-সদস্যদের মধ্যে রয়েছেন ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি, হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি, ইউনিভার্সিটি অব পেনসিলভানিয়া এবং ইউনিভার্সিটি অব সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়ার মতো শীর্ষ গবেষণা প্রতিষ্ঠান থেকে আগত বিশেষজ্ঞগণ।
গবেষণায় আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি
এই নিযুক্তির পাশাপাশি বাহাউদ্দিন পেয়েছেন ২০২৫ সালের ‘ডিনস অ্যাওয়ার্ড ফর এক্সিলেন্স ইন রিসার্চ ফর অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর’—UIUC-এর ‘The Grainger College of Engineering’–এর অন্যতম সম্মানজনক পুরস্কার। এই পুরস্কার প্রতিবছর কলেজের ১২টি বিভাগের কয়েকজন সহকারী অধ্যাপককে তাদের অসাধারণ গবেষণার স্বীকৃতি হিসেবে দেওয়া হয়।
গবেষণার কেন্দ্রবিন্দুতে এআই ও নিউক্লিয়ার এনার্জি
বাহাউদ্দিনের গবেষণায় মূল লক্ষ্য হলো পরমাণু শক্তি ব্যবস্থাকে আরও নিরাপদ, নির্ভরযোগ্য ও রিয়েল টাইমে পর্যবেক্ষণযোগ্য করা। এ জন্য তিনি তৈরি করেছেন ‘ডিজিটাল টুইন’ প্রযুক্তিনির্ভর একটি ভার্চুয়াল পরিবেশ, যেখানে বাস্তব সেন্সরের জায়গায় কম্পিউটেশনাল মডেল ব্যবহার করে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ প্যারামিটার—যেমন তাপমাত্রা, চাপ, প্রবাহ ইত্যাদি—মাত্র মিলিসেকেন্ডে অনুমান করা যায়।
এই পদ্ধতির মাধ্যমে ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে ফিজিক্যাল সেন্সর বসানোর ঝুঁকি কমে এবং পর্যবেক্ষণের গতি ও নির্ভরযোগ্যতা বহুগুণ বেড়ে যায়। এর ফলে পরমাণু চুল্লির অভ্যন্তরের বিপজ্জনক সমস্যা আগেভাগেই শনাক্ত করা সম্ভব।
গবেষণা দল ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
বাহাউদ্দিনের নেতৃত্বে তাঁর গবেষণাগারে বর্তমানে কাজ করছেন পিএইচডি গবেষক কাজুমা কোবায়াশি, ফরিদ আহমেদ, সমরেন্দ্র রয় ও ট্রেভর তালবট। তাঁরা যৌথভাবে এআই এবং নিউক্লিয়ার নিরাপত্তার সংযোগস্থলে গবেষণা চালাচ্ছেন।
তাঁর পরিকল্পনা আছে বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের জন্যও এমন গবেষণার সুযোগ তৈরি করার। তিনি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সহযোগিতায় বাংলাদেশের তরুণ গবেষকদের AI ও এনার্জি খাতে প্রশিক্ষণের উদ্যোগ নিতে চান।
ব্যতিক্রমী যাত্রাপথ
সৈয়দ বাহাউদ্দিন আলমের এই অর্জনের পেছনে রয়েছে এক অনুপ্রেরণামূলক যাত্রা। ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজ থেকে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শেষ করে বুয়েট থেকে ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন তিনি। পরবর্তীতে যুক্তরাজ্যের কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নিউক্লিয়ার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে মাস্টার্স ও পিএইচডি সম্পন্ন করেন।
তিনি কাজ করেছেন যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স ও দক্ষিণ কোরিয়ায়। প্রথমে শিক্ষকতা শুরু করেন মিজৌরি ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজিতে। সেখানে তিনি “MARSHAINS” (Machine Learning and Artificial Intelligence for Advancing Nuclear Systems) নামের একটি গবেষণাগার প্রতিষ্ঠা করেন, যা পরে UIUC-তে স্থানান্তরিত হয়।
পারিবারিক প্রেরণা
২০১৯ সালের শেষ দিকে যুক্তরাষ্ট্রে স্থায়ী হন বাহাউদ্দিন। বর্তমানে তার পরিবারে রয়েছেন স্ত্রী তোহফাতুর রিদওয়ান এবং তাদের দুই সন্তান—ছয় বছর বয়সী ইকরা সৈয়দা এবং এক বছর বয়সী ইবাদ সৈয়দ। তিনি বলেন, তার এই অগ্রযাত্রায় স্ত্রী এবং পরিবারের অবদান সবচেয়ে বেশি।
এআই নিয়ে দৃষ্টিভঙ্গি
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে জনমানুষের ভীতি সম্পর্কে বাহাউদ্দিন বলেন, ‘‘এআই হলো শিশুর মতো—যেভাবে শেখানো হবে, সেভাবেই কাজ করবে। গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা এখনও মানুষের হাতেই রয়েছে। তবে এআই মানুষের সহযোগী হয়ে নানা সমস্যার দ্রুত সমাধানে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে।’’
তিনি আরও যোগ করেন, ‘‘আমরা এমন একটি পদ্ধতি তৈরি করেছি, যা প্রচলিত কম্পিউটেশনাল মডেলের চেয়ে এক হাজার গুণ দ্রুত ফলাফল দিতে পারে। এতে পরমাণু শক্তি ব্যবস্থার নির্ভরযোগ্যতা বহুগুণ বেড়ে যায়।’’
ভবিষ্যতের স্বপ্ন
বাহাউদ্দিনের স্বপ্ন একটি ঝুঁকিমুক্ত ও টেকসই পারমাণবিক শক্তিনির্ভর বিশ্ব গড়ে তোলা। এবং তিনি বিশ্বাস করেন, NASEM-এর এই কমিটিতে অংশ নেওয়ার সুযোগ তাঁকে গবেষণা ও নীতিনির্ধারণ উভয় ক্ষেত্রেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনের সুযোগ করে দেবে।
সৈয়দ বাহাউদ্দিন আলমের কৃতিত্ব কেবল একজন বাংলাদেশি বিজ্ঞানীর আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে সফলতা নয়, বরং এটি একটি বড় অনুপ্রেরণা, যেখানে মেধা, পরিশ্রম, পারিবারিক সমর্থন এবং স্বপ্ন মিলিয়ে তৈরি হয় বিশ্বমানের একটি গবেষণা জীবনের গল্প।