বানিজ্য

সুন্দরবনের মধুসহ ২৪ পণ্য পেল জিআই সনদ

বাংলাদেশের সমৃদ্ধ ঐতিহ্য ও স্থানীয় উৎপাদনের স্বীকৃতি হিসেবে আরও ২৪টি পণ্য পেয়েছে ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) সনদ। এর মধ্যে রয়েছে সুন্দরবনের বিখ্যাত মধু, সিলেটের মণিপুরি শাড়ি, সিরাজগঞ্জের গামছা, মাগুরার হাজরাপুরী লিচু, নওগাঁর নাকফজলি আমসহ বিভিন্ন অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী পণ্য। এই সনদ প্রদানের মাধ্যমে বাংলাদেশে জিআই স্বীকৃতি পাওয়া পণ্যের সংখ্যা এখন দাঁড়িয়েছে ৫৫টিতে। গত ৩০ এপ্রিল রাজধানীর বেইলি রোডে ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে বিশ্ব মেধাসম্পদ দিবস ২০২৫ উপলক্ষে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে এই সনদ হস্তান্তর করা হয়। শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীন পেটেন্ট, শিল্প-নকশা ও ট্রেডমার্কস অধিদপ্তর (ডিপিডিটি) এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।

অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সংস্কৃতি বিষয়ক উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী এবং বিশেষ অতিথি ছিলেন শিল্প উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান। সভাপতিত্ব করেন শিল্প সচিব মো. ওবায়দুর রহমান। বিশ্ব মেধাসম্পদ দিবসের প্রতিপাদ্য ‘আইপি অ্যান্ড মিউজিক: ফিল দ্য বিট অব আইপি’ অনুসরণ করে এ বছর সংগীতশিল্পী, সুরকার, গীতিকারসহ সৃজনশীল ব্যক্তিদের মেধাসম্পদ সুরক্ষার ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়। এই প্রেক্ষাপটে মেধাসম্পদ দিবসের মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বিশিষ্ট শিল্পী, অভিনেত্রী ও সংগীত পরিচালক আরমিন মুসা।

জিআই সনদ: বাংলাদেশের ঐতিহ্যের বিশ্বমঞ্চে উত্তরণ

ভৌগোলিক নির্দেশক বা জিআই সনদ এমন একটি স্বীকৃতি, যা কোনো নির্দিষ্ট অঞ্চলের সঙ্গে পণ্যের উৎপত্তি, গুণগত মান ও ঐতিহ্যের সম্পর্ককে নিশ্চিত করে। এটি শুধুমাত্র পণ্যের স্বতন্ত্রতাই তুলে ধরে না, বরং স্থানীয় উৎপাদক ও কারিগরদের অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বাংলাদেশে জিআই সনদ প্রদানের কার্যক্রম শুরু হয় ২০১৩ সালে ‘ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য (নিবন্ধন ও সুরক্ষা) আইন’ প্রণয়নের মাধ্যমে। ২০১৫ সালে এই আইনের বিধিমালা জারি করার পর থেকে ডিপিডিটি এই প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করেছে। দেশের প্রথম জিআই স্বীকৃতি পায় জামদানি শাড়ি, যা বাংলাদেশের হস্তশিল্পের একটি শ্রেষ্ঠ নিদর্শন। এরপর থেকে ধীরে ধীরে বিভিন্ন পণ্য এই তালিকায় যুক্ত হয়েছে।

শিল্প উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান বলেন, “জিআই সনদ শুধু পণ্যের স্বীকৃতি নয়, এটি আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির প্রতিনিধিত্ব করে। এই স্বীকৃতির মাধ্যমে স্থানীয় উদ্যোক্তা ও উৎপাদকরা আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতা করতে পারবেন। তবে জিআই পণ্যের তালিকা সমৃদ্ধ করার পাশাপাশি এগুলোর বাণিজ্যিক উন্নয়নের দিকেও নজর দিতে হবে।” তিনি আরও জানান, জিআই সনদপ্রাপ্ত পণ্যের বাজারজাতকরণে স্থানীয় উৎপাদকদের ন্যায্য পারিশ্রমিক নিশ্চিত করা হবে, যা তাদের জীবনমান উন্নয়নে সহায়ক হবে।

নতুন জিআই পণ্য: বৈচিত্র্যের প্রতিফলন

নতুন স্বীকৃতি পাওয়া ২৪টি পণ্য বাংলাদেশের ভৌগোলিক ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের একটি প্রতিচ্ছবি। এই পণ্যগুলোর মধ্যে রয়েছে:

  • নরসিংদীর লটকন: এই ফল তার স্বতন্ত্র স্বাদ ও গুণগত মানের জন্য বিখ্যাত।
  • মধুপুরের আনারস: টাঙ্গাইলের মধুপুরের মিষ্টি ও রসালো আনারস দেশজুড়ে জনপ্রিয়।
  • ভোলার মহিষের দুধের কাঁচা দই: এই দই তার ঘন টেক্সচার ও স্বাদের জন্য পরিচিত।
  • মাগুরার হাজরাপুরী লিচু: মাগুরার এই লিচু তার আকার ও মিষ্টতার জন্য বিশেষ।
  • সিরাজগঞ্জের গামছা ও লুঙ্গি: সিরাজগঞ্জের হস্তশিল্পের ঐতিহ্যের প্রতীক এই পণ্যগুলো।
  • সিলেটের মণিপুরি শাড়ি: মণিপুরি সম্প্রদায়ের হাতে বোনা এই শাড়ি তার নকশা ও কারুকার্যের জন্য বিখ্যাত।
  • মিরপুরের কাতান শাড়ি: ঢাকার মিরপুরের এই শাড়ি তার সূক্ষ্ম বুননের জন্য পরিচিত।
  • ঢাকাই ফুটি কার্পাস তুলা ও এর বীজ-গাছ: ঐতিহ্যবাহী তুলার এই প্রজাতি বাংলাদেশের কৃষি ঐতিহ্যের অংশ।
  • কুমিল্লার খাদি: হাতে বোনা এই কাপড় পরিবেশবান্ধব ও আরামদায়ক।
  • ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ছানামুখী মিষ্টি: এই মিষ্টি তার অনন্য স্বাদের জন্য স্থানীয়দের কাছে জনপ্রিয়।
  • গোপালগঞ্জের ব্রোঞ্জের গয়না: এই গয়না হস্তশিল্পের একটি শ্রেষ্ঠ নিদর্শন।
  • সুন্দরবনের মধু: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ বন থেকে সংগৃহীত এই মধু তার বিশুদ্ধতা ও ঔষধি গুণের জন্য বিখ্যাত।
  • শেরপুরের ছানার পায়েস: শেরপুরের এই ঐতিহ্যবাহী মিষ্টান্ন স্থানীয় সংস্কৃতির অংশ।
  • গাজীপুরের কাঁঠাল: গাজীপুরের কাঁঠাল তার আকার ও স্বাদের জন্য পরিচিত।
  • কিশোরগঞ্জের রাতাবোরো ধান: এই ধানের জাত তার গুণগত মানের জন্য বিশেষ।
  • অষ্টগ্রামের পনির: কিশোরগঞ্জের এই পনির তার স্বাদ ও টেক্সচারের জন্য জনপ্রিয়।
  • বরিশালের আমড়া: এই ফল তার টক-মিষ্টি স্বাদের জন্য বিখ্যাত।
  • কুমারখালীর বেডশিট: কুষ্টিয়ার এই হস্তশিল্প পণ্য তার নকশার জন্য পরিচিত।
  • দিনাজপুরের বেদানা লিচু: এই লিচু তার স্বতন্ত্র গন্ধ ও স্বাদের জন্য বিশেষ।
  • মুন্সীগঞ্জের পাতক্ষীর: এই দুগ্ধজাত পণ্য তার ঘনত্ব ও স্বাদের জন্য জনপ্রিয়।
  • নওগাঁর নাকফজলি আম: এই আম তার মিষ্টতা ও গন্ধের জন্য বিখ্যাত।
  • টাঙ্গাইলের মির্জাপুরের জামুর্কির সন্দেশ: এই মিষ্টি তার অনন্য প্রস্তুত প্রণালীর জন্য পরিচিত।

এই সনদগুলো বাংলাদেশ তাঁত বোর্ড, সংশ্লিষ্ট জেলার জেলা প্রশাসক এবং নওগাঁর বদলগাছি উপজেলার নাকফজলি আমচাষি সমবায় সমিতির কাছে হস্তান্তর করা হয়।

সুন্দরবনের মধু: বাংলাদেশ-ভারত বিতর্ক

সুন্দরবনের মধু এবার বাংলাদেশের জিআই সনদ পেলেও এই পণ্য নিয়ে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে আলোচনা চলছে। ২০২৪ সালে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ সুন্দরবনের মধুকে তাদের জিআই পণ্য হিসেবে নিবন্ধন করে। এই পদক্ষেপের পর বাংলাদেশে শঙ্কা দেখা দেয় যে, এটি মধুর আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ও বাজারে প্রভাব ফেলতে পারে। সুন্দরবনের ৬০ শতাংশই বাংলাদেশে অবস্থিত এবং এই অঞ্চলের মধু বাংলাদেশে ব্যাপক জনপ্রিয়। ২০১৭ সালে বাগেরহাটের জেলা প্রশাসক সুন্দরবনের মধুকে জিআই পণ্য হিসেবে নিবন্ধনের জন্য আবেদন করেছিলেন। গত ৩০ জুন এই আবেদন জার্নাল আকারে প্রকাশিত হয় এবং দুই মাসের মধ্যে কোনো আপত্তি না উঠলে এটি চূড়ান্ত নিবন্ধন পাবে।

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, জিআই সনদ বাংলাদেশের মধুর আন্তর্জাতিক বাজারে চাহিদা ও দাম বাড়াতে সহায়ক হবে। তবে ভারতের সঙ্গে এই পণ্যের প্রতিযোগিতায় জটিলতা এড়াতে দ্বিপক্ষীয় চুক্তির প্রয়োজন। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) এর সম্মাননীয় ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, “বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে জিআই বিষয়ে একটি সমঝোতা হওয়া উচিত, যাতে উভয় দেশের স্বার্থ সংরক্ষিত হয়।”

সংস্কৃতি ও মেধাসম্পদ: একটি সমন্বিত দৃষ্টিভঙ্গি

অনুষ্ঠানে সংস্কৃতি বিষয়ক উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী বলেন, “বাংলাদেশের সংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো গান। আমাদের মানুষ গানের মাধ্যমে তাদের আবেগ ও ভাব প্রকাশ করে। সংগীতের মেধাসম্পদ সুরক্ষিত করতে কপিরাইট নিশ্চিত করা জরুরি।” তিনি জানান, সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় সংগীত সংরক্ষণ ও উন্নয়নের জন্য একটি বড় প্রকল্পে কাজ করছে, যা শিগগিরই জনসাধারণের সামনে আসবে।

শিল্প সচিব মো. ওবায়দুর রহমান বলেন, “জিআই সনদপ্রাপ্ত পণ্যগুলো বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের পরিচিতি বাড়াবে। এই পণ্যগুলোর গুণগত মান বজায় রাখা এবং বাজারজাতকরণে শিল্প মন্ত্রণালয় কাজ করছে।” তিনি আরও বলেন, মেধাসম্পদ মানুষের সৃজনশীলতা ও উদ্ভাবনের একটি অধিকার, যা সংরক্ষণ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

অর্থনৈতিক সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ

জিআই সনদপ্রাপ্ত পণ্যগুলো বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। এই স্বীকৃতি স্থানীয় উৎপাদকদের আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতার সুযোগ করে দেবে। বিশেষ করে সুন্দরবনের মধু, মণিপুরি শাড়ি, কুমিল্লার খাদি ও নাকফজলি আমের মতো পণ্যগুলোর রপ্তানি সম্ভাবনা বৃদ্ধি পাবে। তবে এই সম্ভাবনা কাজে লাগাতে বাজারজাতকরণ, গুণগত মান নিয়ন্ত্রণ এবং প্রচারণার ক্ষেত্রে আরও উদ্যোগ নিতে হবে।

একই সঙ্গে, ভারতের সঙ্গে সুন্দরবনের মধু ও টাঙ্গাইল শাড়ির মতো পণ্যের জিআই স্বীকৃতি নিয়ে বিতর্ক এড়াতে কূটনৈতিক পদক্ষেপ জরুরি। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, দুই দেশের মধ্যে একটি পারস্পরিক সমঝোতা এই সমস্যার সমাধানে সহায়ক হবে।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button