প্রযুক্তি

মেটার প্রোমিথিয়াস ও হাইপেরিয়ন: বিশ্বের প্রথম এআই সুপারক্লাস্টার

বিশ্বব্যাপী কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) প্রযুক্তিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে এবার অগ্রণী ভূমিকা নিতে যাচ্ছে প্রযুক্তি জায়ান্ট মেটা (Meta)। সোমবার (১৪ জুলাই), ফেসবুকে দেওয়া এক ঘোষণায় মেটার সিইও মার্ক জাকারবার্গ জানান, ২০২৬ সালে তারা চালু করতে যাচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী এআই সুপারক্লাস্টার ‘প্রোমিথিয়াস’ (Prometheus)। একইসঙ্গে কাজ চলছে আরও বড় পরিসরে তৈরি হওয়া সুপারক্লাস্টার ‘হাইপেরিয়ন’ (Hyperion)-এর দিকেও।

এই উদ্যোগ শুধুমাত্র প্রযুক্তিগত নয়—এটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা গবেষণা ও ব্যবহারের নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে। মেটার লক্ষ্য হলো সুপার ইন্টেলিজেন্স তৈরির মাধ্যমে ওপেনএআই, গুগল ও অ্যাপলের মতো প্রতিদ্বন্দ্বীদের সঙ্গে সমানে টেক্কা দেওয়া।

প্রোমিথিয়াস: মেটার প্রথম এআই সুপারক্লাস্টার

জাকারবার্গের ঘোষণা অনুযায়ী, ২০২৬ সালের মধ্যে যাত্রা শুরু করবে ‘প্রোমিথিয়াস’। এটি হবে মেটার প্রথম পূর্ণাঙ্গ এআই সুপারক্লাস্টার। সুপারক্লাস্টার হলো এমন এক ধরনের কম্পিউটিং সিস্টেম, যা প্রচুর সংখ্যক GPU (গ্রাফিক্স প্রসেসিং ইউনিট) ও উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন সার্ভারের মাধ্যমে বিশাল পরিমাণ ডেটা প্রক্রিয়াকরণে সক্ষম।

জাকারবার্গ বলেন, “আমরা মেটা সুপার ইন্টেলিজেন্স ল্যাবসে এমন এক কাঠামো গড়ে তুলছি, যা গবেষকপ্রতি সর্বোচ্চ কম্পিউটিং রিসোর্স দেবে। এটি হবে ইন্ডাস্ট্রির সর্বোচ্চ সক্ষমতার প্ল্যাটফর্ম।”

হাইপেরিয়ন: শক্তির নতুন মাইলফলক

‘হাইপেরিয়ন’ হচ্ছে মেটার পরবর্তী ধাপের প্রকল্প। এটি শুধু আরও বড় নয়, বরং হবে বিদ্যুৎ ব্যবহারে অভূতপূর্ব। মেটা জানিয়েছে, এই সুপারক্লাস্টার কয়েক বছরের মধ্যে ৫ গিগাওয়াট বিদ্যুৎ ব্যবহারের ক্ষমতা অর্জন করবে—যা অনেক দেশের জাতীয় গ্রিডের সমান শক্তিশালী।

বিশ্বের সবচেয়ে বড় ডেটাসেন্টারগুলোর তুলনায় হাইপেরিয়ন হবে আরও বৃহৎ, পরিবেশবান্ধব এবং ভবিষ্যতের AI চাহিদা মেটাতে প্রস্তুত।

মেটা সুপার ইন্টেলিজেন্স ল্যাবস: AI গবেষণার নতুন কেন্দ্র

২০২৫ সালের জুন মাসে মেটা ঘোষণা দেয়, তারা গঠন করেছে একটি নতুন গবেষণা সংস্থা—Meta Super Intelligence Labs। এর লক্ষ্য হলো সুপার ইন্টেলিজেন্স তৈরি করা, যা ভবিষ্যতের মানুষ-যন্ত্র যোগাযোগকে আরও স্মার্ট, উপযোগী এবং নিরাপদ করবে।

এই ল্যাবে যুক্ত হয়েছেন বিশ্বের শীর্ষ AI গবেষক, ইঞ্জিনিয়ার এবং প্রযুক্তিবিদরা। মেটা ইতিমধ্যেই ওপেনএআই এবং অ্যাপলের অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের দলে টানছে।

জাকারবার্গ বলেন, “আমরা প্রযুক্তির ভবিষ্যৎ গড়তে চাই। এজন্য দরকার সবচেয়ে মেধাবী, প্রতিভাবান এবং নিবেদিত গবেষকদের—তাদের সঙ্গে কাজ করতেই আমরা তৈরি।”

বিনিয়োগে নতুন মাইলফলক: স্কেল এআই-তে ১৪ বিলিয়ন ডলার

শুধু নিজস্ব গবেষণা নয়, অন্য প্রতিষ্ঠানেও বড় অঙ্কের বিনিয়োগ করছে মেটা। সম্প্রতি, তারা Scale AI নামের একটি স্টার্টআপে ১৪ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে। Scale AI মূলত ডেটা লেবেলিং ও AI ট্রেইনিং ডেটা প্রস্তুতের ক্ষেত্রে অগ্রণী প্রতিষ্ঠান।

এই বিনিয়োগের মাধ্যমে মেটা নিজেদের AI মডেল প্রশিক্ষণের জন্য উচ্চমানের এবং নির্ভুল ডেটা নিশ্চিত করতে চায়।

‘লামা ৪’ থেকে প্রোমিথিয়াস পর্যন্ত: ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা

২০২৫ সালের এপ্রিলে মেটা উন্মোচন করেছিল তাদের ভাষাভিত্তিক AI মডেল LLaMA 4 (Large Language Model Meta AI)। তবে প্রত্যাশিত সাফল্য অর্জন করতে না পারায় মেটার নেতৃত্বে হতাশা দেখা দেয়।

এই ব্যর্থতার পরই জাকারবার্গ সিদ্ধান্ত নেন মেটার এআই কৌশলে বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে। প্রোমিথিয়াস ও হাইপেরিয়ন সেই পরিবর্তনের অংশ হিসেবেই সামনে আসছে।

এআই সুপারক্লাস্টার কী এবং কেন গুরুত্বপূর্ণ?

সাধারণ ভাষায়, একটি সুপারক্লাস্টার হচ্ছে হাজার হাজার সার্ভার ও GPU-র একত্রিত নেটওয়ার্ক, যা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রশিক্ষণ, বিশ্লেষণ এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণে কাজ করে। এটি স্বাভাবিক কম্পিউটার বা ক্লাউড সিস্টেমের তুলনায় অনেক বেশি গতিশীল, শক্তিশালী এবং নির্ভরযোগ্য।

এআই মডেল যেমন GPT-4, LLaMA, Gemini বা Claude প্রশিক্ষণের জন্য হাজার কোটি তথ্যের প্রয়োজন হয়। এই বিশাল পরিমাণ ডেটা প্রক্রিয়াকরণে সুপারক্লাস্টারই পারে নির্ভুল, দ্রুত ও নিরবিচারে কাজ করতে।

মেটার এই পদক্ষেপের প্রভাব বিশ্বজুড়ে

বিশেষজ্ঞদের মতে, মেটার এই উদ্যোগ কেবল নিজেদের AI ক্ষমতা বাড়াবে না, বরং প্রতিযোগী প্রতিষ্ঠানগুলোকে নতুন করে কৌশল সাজাতে বাধ্য করবে। মাইক্রোসফট, গুগল, অ্যাপল এবং অ্যামাজনের মতো টেক জায়ান্টরা এরই মধ্যে নিজেদের AI অবকাঠামো প্রসারে ব্যস্ত। তবে মেটার এই সুপারক্লাস্টার প্রকল্প আগামী কয়েক বছরে প্রযুক্তি বিশ্বে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

একটি সাহসী আগ্রাসী পদক্ষেপ

প্রোমিথিয়াস ও হাইপেরিয়ন শুধু সুপারক্লাস্টার নয়—এগুলো হলো মেটার ভবিষ্যতের রোডম্যাপ। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, ডেটা প্রসেসিং, মেশিন লার্নিং এবং মানব-যন্ত্র ইন্টারঅ্যাকশনের জগতে এটি একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। মেটা আবারও প্রমাণ করল—তারা শুধু সোশ্যাল মিডিয়ায় সীমাবদ্ধ থাকতে চায় না, বরং আগামী প্রজন্মের প্রযুক্তির রূপকার হতে চায়।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button