অর্থনীতি

করব্যবস্থার সংস্কার হতে হবে অন্তর্ভুক্তিমূলক

দেশে রাজস্ব আদায় বৃদ্ধির পাশাপাশি করদাতাবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করতে করব্যবস্থার সংস্কার অত্যন্ত জরুরি। তবে এই সংস্কার প্রক্রিয়া হতে হবে অন্তর্ভুক্তিমূলক, যেখানে অংশীজনদের মতামতকে গুরুত্ব দেওয়া হবে। বাস্তবসম্মত সিদ্ধান্ত গ্রহণের মাধ্যমে করনীতি সংস্কার না হলে তা টেকসই হবে না। তবে, বাস্তবে দেখা যাচ্ছে যে অংশীজনদের সঙ্গে পরামর্শ না করেই সরকার বিভিন্ন পণ্য ও সেবায় কর বৃদ্ধি করেছে, যার ফলে শিল্প ও সেবা খাতের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। এর ফলে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান হুমকির মুখে পড়েছে এবং সম্ভাব্য রাজস্ব আদায় হ্রাসের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

আজ বুধবার রাজধানীর একটি হোটেলে পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশ আয়োজিত ‘করনীতির কাঠামো পরিচালনা: গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলোর জন্য প্রভাব ও অগ্রাধিকার’ শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠকে এসব কথা বলেন বক্তারা। সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খান এবং সঞ্চালনা করেন পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের চেয়ারম্যান ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মাশরুর রিয়াজ।

সংস্কারের গুরুত্ব ও শিল্প খাতের মতামত

অনুষ্ঠানে কৃষি প্রক্রিয়াকরণ, জ্বালানি, তামাক ও ভোগ্যপণ্য খাতের সাম্প্রতিক করনীতির পরিবর্তন ও তার প্রভাব নিয়ে আলোচনা করা হয়। বক্তারা বলেন, বিভিন্ন খাতে কর বৃদ্ধির ফলে ব্যবসা-বাণিজ্য এবং বিদেশি বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। ফলে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ও রাজস্ব আদায় নিশ্চিত করতে অন্তর্ভুক্তিমূলক করনীতি গ্রহণ করা জরুরি।

এনবিআর চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খান বলেন, ‘সরকার এমন একটি করব্যবস্থা নিশ্চিত করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, যা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে সহায়তা করবে ও আর্থিক শৃঙ্খলা বজায় রাখবে। আমাদের করনীতির লক্ষ্য হলো রাজস্ব আহরণ ও ব্যবসায়িক প্রবৃদ্ধির মধ্যে ভারসাম্য তৈরি করা।’ তিনি আরও বলেন, ‘করনীতিতে পরিবর্তনশীল অর্থনৈতিক বাস্তবতার প্রতিফলন থাকা প্রয়োজন এবং এ বিষয়ে অংশীজনদের মতামত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।’

বিনিয়োগকারীদের উদ্বেগ

মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এমসিসিআই), ঢাকার সভাপতি কামরান টি রহমান বলেন, ‘করনীতিতে বড় পরিবর্তন আনার আগে নীতিনির্ধারক ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে গঠনমূলক সংলাপ হওয়া উচিত। কর সংস্কার অংশীজনদের মতামত বিবেচনায় এনে করতে হবে, তা না হলে অর্থনৈতিক অস্থিরতা তৈরি হতে পারে।’

ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো বাংলাদেশের (বিএটিবি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মনীষা আব্রাহাম বলেন, ‘দেশে বৈধ ব্যবসায় ব্যয় বাড়ছে। অতিরিক্ত করের কারণে ব্যবসার পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। তামাক খাতে মোট শুল্ক-কর ৮৩ শতাংশে পৌঁছেছে, যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশকৃত ৭৫ শতাংশের চেয়েও বেশি।’ তিনি বলেন, ‘আমরা চাই, বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ুক। এ জন্য বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। নীতিনির্ধারণের সময় অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা করা হলে এই পরিবেশ নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।’

প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের চেয়ারম্যান আহসান খান চৌধুরী বলেন, ‘করহারে ঘন ঘন পরিবর্তন বিদেশি বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থার সংকট তৈরি করছে। দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীরা একটি স্থিতিশীল করনীতির প্রত্যাশা করেন।’

জাপান টোব্যাকো ইন্টারন্যাশনালের (জেটিআই) ব্যবস্থাপনা পরিচালক পল হলওয়ে বলেন, ‘সম্প্রতি বিভিন্ন পণ্য ও সেবায় কর বৃদ্ধি করা হয়েছে, যা তামাক খাতসহ বিভিন্ন শিল্প খাতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।’ তিনি সতর্ক করেন যে, ‘এতে অবৈধ ব্যবসা বাড়তে পারে, যা বৈধ ব্যবসায়ীদের ক্ষতিগ্রস্ত করবে এবং সরকারের রাজস্ব আদায়ের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।’

নীতিনির্ধারকদের দৃষ্টিভঙ্গি ও সুপারিশ

এনবিআরের সাবেক সদস্য ও এনবিআর সংস্কার কমিটির সদস্য ফরিদ উদ্দিন বলেন, ‘আমরা অংশীজনদের সঙ্গে কথা বলেছি এবং তাদের মতামতের ভিত্তিতে বেশ কিছু সুপারিশ দিয়েছি।’

দৈনিক সমকাল-এর সহযোগী সম্পাদক জাকির হোসেন বলেন, ‘করনীতি যে কোনো পরিবর্তনের আগে অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা করা হলে তা সবাই গ্রহণযোগ্য মনে করবে।’

অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) মহাপরিচালক মো. আরিফুল হক, নেসলে বাংলাদেশের কোম্পানি সচিব দেবব্রত রায় চৌধুরী, লাফার্জহোলসিম বাংলাদেশের পরিচালক ও সিইও ইকবাল চৌধুরী, আইসিএমএবি সভাপতি মাহতাব উদ্দিন আহমেদ প্রমুখ।

প্রস্তাবিত কর সংস্কারের সুপারিশ

বক্তারা করনীতি সংস্কারের জন্য বেশ কিছু সুপারিশ তুলে ধরেন:

১. অংশীজনদের সম্পৃক্ত করা: কর সংক্রান্ত যে কোনো পরিবর্তনের আগে ব্যবসায়ী, বিনিয়োগকারী ও অন্যান্য অংশীজনদের মতামত গ্রহণ করা। ২. করপোরেট করের হার সামঞ্জস্যপূর্ণ করা: করপোরেট করের হার এমনভাবে নির্ধারণ করতে হবে যাতে বিনিয়োগকারীদের জন্য এটি আকর্ষণীয় হয়। ৩. স্থিতিশীল করনীতি নিশ্চিত করা: ঘন ঘন করহার পরিবর্তনের পরিবর্তে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করা। ৪. অবৈধ ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ: অতিরিক্ত করের ফলে অবৈধ ব্যবসার প্রসার রোধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা। ৫. কর সংস্কার কমিটি গঠন: সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষের অংশগ্রহণে একটি কার্যকর কর সংস্কার কমিটি গঠন করা।

সার্বিকভাবে, অন্তর্ভুক্তিমূলক কর সংস্কারের মাধ্যমে ব্যবসা-বাণিজ্যের স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে, যা বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধিতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে এবং দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে ত্বরান্বিত করবে।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button