বানিজ্য

পদ্মার আড়াই কেজির ইলিশ ১৩ হাজার টাকায় বিক্রি

চাঁদপুরে পদ্মা নদী থেকে ধরা একটি আড়াই কেজি ওজনের ইলিশ মাছ ১৩ হাজার ৩৯০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। মঙ্গলবার (৩ জুন) সকালে সদর উপজেলার বড় স্টেশন মাছঘাটের এক আড়তে এই উন্মুক্ত নিলাম অনুষ্ঠিত হয়। ইলিশের অভাব ও আকারে বিশাল হওয়ায় মাছটি ঘিরে স্থানীয় বাজারে ব্যাপক আগ্রহ সৃষ্টি হয়।

এটি ২০২৫ সালের ইলিশ মৌসুমে চাঁদপুরের অন্যতম দামি ইলিশ বলে জানিয়েছেন স্থানীয় আড়তদার ও ব্যবসায়ীরা। জানা গেছে, চাঁদপুর সদরের বিখ্যাত বড় স্টেশন মাছঘাটে আড়তদার আনোয়ার গাজীর গদিতে ইলিশটির নিলাম হয়। প্রায় ৩০ জন মাছ ব্যবসায়ী সেখানে অংশ নেন। সর্বোচ্চ দর হাঁকিয়ে মাছটি কিনে নেন মাছ বিক্রেতা হারুন মোল্লা।

২ কেজি ৪৮০ গ্রাম ওজনের রাজা ইলিশ

হারুন মোল্লা বলেন, “এই মৌসুমে এত বড় ইলিশ আমরা এই প্রথম পেয়েছি। আমার নির্দিষ্ট কিছু ক্রেতা আছেন ঢাকায়, যারা বড় ও প্রিমিয়াম ইলিশের জন্য অপেক্ষা করেন। তাদেরই একজন এই মাছটি নিতে পারেন বলে আশা করছি।”

ইলিশটির ওজন ছিল ২ কেজি ৪৮০ গ্রাম, অর্থাৎ প্রায় আড়াই কেজি। প্রতি কেজি গড়ে দাম দাঁড়ায় প্রায় ৫,৪০০ টাকা, যা এই মৌসুমের গড় বাজারদরের চেয়ে দ্বিগুণ।

চাঁদপুরে ইলিশের আকাল, বাড়ছে দাম

চাঁদপুর মৎস্য ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক শবে বরাত জানান, সাম্প্রতিক সময়ে চাঁদপুরের পদ্মা-মেঘনার মোহনায় ইলিশের সরবরাহ অনেক কমে গেছে। প্রতিদিন যেখানে গড়ে ১০০-১৫০ মণ ইলিশ আসার কথা, সেখানে এখন আসছে মাত্র ৫-১০ মণ। ফলে বাজারে চাহিদা বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে এবং দামও কমছে না।

তিনি বলেন, “বছরের এই সময়টায় সাধারণত ইলিশের মৌসুম জমজমাট থাকার কথা। কিন্তু এবছর তেমনটি দেখা যাচ্ছে না। নদীতে জেলেরা অনেক সময় জাল ফেলেও খালি হাতে ফিরছেন। ফলে যেটুকু ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে, সেটিই উচ্চদামে বিক্রি হচ্ছে।”

পূর্বের দামি ইলিশের নজির

২০২৫ সালের মে মাসেও চাঁদপুরে বেশ কয়েকটি বড় ও দামি ইলিশ বিক্রির খবর পাওয়া গেছে। যেমন ২০ মে এক নিলামে ২ কেজি ওজনের একটি ইলিশ বিক্রি হয়েছিল ৮ হাজার ৪০০ টাকায়। আবার ১৬ মে পদ্মায় ধরা পড়া দুটি ইলিশ একসঙ্গে বিক্রি হয় ১৪ হাজার ৫০০ টাকায়।

তবে ১৩ হাজার ৩৯০ টাকায় বিক্রি হওয়া এই ইলিশটি এ মৌসুমের সবচেয়ে দামি একক ইলিশ হিসেবে ধরা হচ্ছে।

ক্রেতা কোথায়?

এমন উচ্চমূল্যের ইলিশ কারা কেনেন? এ প্রসঙ্গে ব্যবসায়ী হারুন মোল্লা বলেন, “ঢাকার অনেক বিত্তবান ও রেস্তোরাঁ মালিকরা বড় ইলিশের খোঁজে থাকেন। তারা শুধু আকার নয়, পদ্মার গন্ধযুক্ত ইলিশের জন্য বাড়তি দাম দিতেও রাজি থাকেন। তাদের জন্যই এই ধরনের মাছ সংরক্ষণ করি।”

চাঁদপুরের স্থানীয় বাজারেও একশ্রেণির মানুষ বড় ইলিশ কিনতে আগ্রহী থাকেন। তবে অধিকাংশ সাধারণ ক্রেতা এখন ইলিশের এই উচ্চমূল্য দেখে হতাশ।

সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ

চাঁদপুর শহরের বাসিন্দা হাফিজা আক্তার বলেন, “আগে প্রতি সপ্তাহেই ৫০০-৬০০ টাকায় একটা মাঝারি ইলিশ কিনতাম। এখন সেই একই মাছ ১২০০-১৫০০ টাকার নিচে পাওয়া যায় না। বড় ইলিশ তো কল্পনার বাইরে। মাঝেমধ্যে শুধু মাথাটা কিনে তরকারিতে রান্না করি।”

ইলিশের ঘাটতি কেন?

বিশেষজ্ঞ ও মৎস্য কর্মকর্তাদের মতে, এবার নদীতে ইলিশের সংখ্যা কমে যাওয়ার পেছনে কয়েকটি কারণ রয়েছে—
১. নদীর পানিপ্রবাহে পরিবর্তন,
২. অতিরিক্ত ট্রলার ও নিষিদ্ধ জালের ব্যবহার,
৩. নদীর তলদেশে অব্যাহত পলি জমা ও নাব্য সংকট,
৪. মাছের প্রজনন মৌসুমে সম্পূর্ণ নিষেধাজ্ঞা বাস্তবায়নে দুর্বলতা।

সরকার কী বলছে?

চাঁদপুর জেলা মৎস্য কর্মকর্তা তানভীর আহমেদ বলেন, “আমরা এখনও আশা করছি জুন-জুলাইয়ের দিকে ইলিশের পরিমাণ বাড়বে। তবে এবার প্রাকৃতিকভাবে কিছু প্রতিকূলতা থাকায় জেলেদের জালে তেমন মাছ আসছে না। মাছ ধরা নিষিদ্ধ সময়গুলোতে আরও কড়াকড়ি বাস্তবায়নের চেষ্টা করছি যাতে আগামী মৌসুমে ঘাটতি পুষিয়ে ওঠা যায়।শেষ কথা

পদ্মার ১৩ হাজার টাকার ইলিশ নিয়ে আজ সারা দেশের মাছপ্রেমীদের মধ্যে ব্যাপক আলোচনা তৈরি হয়েছে। তবে এই ঘটনার মধ্য দিয়ে দেশের মাছ বাজারের বাস্তব সংকট এবং সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে যাওয়া ইলিশের দামের চিত্রও সামনে এসেছে।

দামি ইলিশে ঢাকার রেস্তোরাঁর দৃষ্টিনন্দন ছবি হয়তো অনেকে দেখেন, কিন্তু চাঁদপুরের ঘাটে ইলিশের ঘাটতি এবং জেলেদের হতাশা এখনও গভীর বাস্তবতা। তাই এখন সময়, শুধু দাম নয়—নদী রক্ষা, মাছের প্রজনন এবং টেকসই মৎস্যনীতি নিয়ে নতুন করে ভাবার।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button