বাংলাদেশ

এশিয়ার নতুন ইতিহাস রচনায় বাংলাদেশ-জাপান একসঙ্গে কাজ করতে পারে: ড. ইউনূস

নোবেলজয়ী ও বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, এশিয়ার ভবিষ্যৎ এখনো লেখা হয়নি, আর তা একসঙ্গে লিখতে পারে বাংলাদেশ ও জাপান। জাপানে অনুষ্ঠিত ‘নিক্কেই ফোরাম: ফিউচার অব এশিয়া’—শীর্ষক আলোচনায় অংশ নিয়ে তিনি এ আশাবাদ ব্যক্ত করেন।

বৃহস্পতিবার (২৯ মে) টোকিওতে অনুষ্ঠিত এই সম্মেলনে ড. ইউনূস বলেন, “বিশ্ব অশান্তির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এমন সংকটে এশিয়ার দেশগুলোর সম্মিলিত পদক্ষেপ মানবিক উন্নয়ন ও শান্তির নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারে।”

২০০৪ সালের পুরস্কার থেকে আজকের নেতৃত্ব

ড. ইউনূস স্মরণ করেন, “২০০৪ সালে আমি যখন নিক্কেই এশিয়া পুরস্কারে ভূষিত হয়েছিলাম, তখন থেকেই জাপানের সঙ্গে একটি গভীর সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। তখন থেকেই আমি জাপানের তরুণ সমাজ, বিশ্ববিদ্যালয় এবং নেতৃত্বের সঙ্গে বারবার দেখা করেছি।”

তিনি বলেন, “জাপানের মানুষ আমার ‘সামাজিক ব্যবসা’ ও ‘ক্ষুদ্রঋণ’ ধারণাকে যেভাবে গ্রহণ করেছে, তা আমাকে মুগ্ধ করেছে। এটি শুধু অর্থনৈতিক ধারণা নয়, এটি একটি নৈতিক রূপান্তর। আর এই রূপান্তরেই লুকিয়ে আছে এশিয়ার ভবিষ্যৎ।”

বিশ্বের ক্রমবর্ধমান অনিশ্চয়তায় এশিয়ার চ্যালেঞ্জ

‘অশান্ত বিশ্বে এশিয়ার চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক আলোচনায় অংশ নিয়ে ড. ইউনূস বলেন, “বিশ্বজুড়ে অস্থিরতা বাড়ছে। ইউক্রেন, গাজা, দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সংঘাত—সবই আমাদের মনে করিয়ে দেয়, শান্তি কোনো স্থায়ী উপাদান নয়। এটি রক্ষা করতে হয়, তৈরি করতে হয়।”

তিনি বলেন, “মিয়ানমারে গৃহযুদ্ধ এবং ভূমিকম্প, দক্ষিণ এশিয়ার দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে সাম্প্রতিক যুদ্ধসহ এসব ঘটনা মানবিক সংকটকে বাড়িয়ে তুলছে। অথচ এই সংঘাতগুলোর পেছনে খরচ হচ্ছে বিলিয়ন ডলার, যখন লাখো মানুষ মৌলিক চাহিদায় হাহাকার করছে।”

বাংলাদেশের রাজনৈতিক রূপান্তর ও গণতন্ত্রের আশা

ড. ইউনূস তাঁর ভাষণে ২০২৪ সালের ‘জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের’ প্রসঙ্গ টেনে বলেন, “বাংলাদেশ ছাত্র নেতৃত্বাধীন গণ-আন্দোলনের মাধ্যমে একটি রূপান্তরমূলক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে গেছে। এই আন্দোলন দেশকে নতুন পথে পরিচালিত করেছে। বর্তমানে আমার সরকার জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে।”

তিনি বলেন, “আমরা গণতন্ত্রে উত্তরণের লক্ষ্যে একটি অবাধ, নিরপেক্ষ ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি। এটি ভুল শোধরানোর, নতুন প্রতিষ্ঠান গড়ার এবং একটি ন্যায্য সমাজ প্রতিষ্ঠার সুযোগ।”

বাংলাদেশের বিশ্ব ভূমিকা ও মানবিক দায়বদ্ধতা

ড. ইউনূস বলেন, “বাংলাদেশ জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে সক্রিয়ভাবে অংশ নিচ্ছে। পাশাপাশি মানবিক কারণে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা ১০ লাখ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়ে বিশ্বকে দেখিয়েছে—মানবতা কেবল নীতির প্রশ্ন নয়, এটি বাস্তবিক প্রয়োগ।”

বিশ্ব সংকটে নতুন নৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রয়োজন

ড. ইউনূস বলেন, “জলবায়ু পরিবর্তন, প্রযুক্তির অগ্রগতি, বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা—সবকিছুই আজ নৈতিক চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে। উন্নয়নশীল দেশগুলো অর্থনৈতিক বৈষম্যের শিকার হচ্ছে, সমাজে আস্থা কমছে।”

তিনি সতর্ক করেন, “বিশ্বজুড়ে নাগরিক, রাষ্ট্র এবং প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যেও বিশ্বাসের সংকট দেখা দিয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ, দক্ষিণ কোরিয়াসহ বিভিন্ন দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা তারই প্রমাণ।”

সম্ভাবনার কেন্দ্রবিন্দু: এশিয়া

ড. ইউনূস বলেন, “বিশ্বের অর্ধেকের বেশি মানুষের আবাসভূমি এশিয়া আজ বৈশ্বিক অনিশ্চয়তার কেন্দ্রবিন্দু হলেও, এটিই সম্ভাবনার কেন্দ্রবিন্দুও। আমাদের সম্মিলিত শক্তি বিশাল, এবং সেই শক্তিকে কাজে লাগিয়ে শান্তি, সংলাপ ও সমতা-ভিত্তিক উন্নয়নের নতুন পথ রচনা করা সম্ভব।”

‘সুপার সুখ’ ও সামাজিক ব্যবসার দর্শন

ড. ইউনূস বলেন, “টাকা বানানো সুখের, কিন্তু মানুষকে খুশি করা হলো ‘সুপার সুখ’। আমাদের দৃষ্টি পরিবর্তন করতে হবে—ব্যক্তিগত মুনাফা থেকে সম্মিলিত কল্যাণে, স্বল্পমেয়াদি লাভ থেকে দীর্ঘমেয়াদি ভবিষ্যতের দিকে।”

তিনি বলেন, “আমি গ্রামীণ ব্যাংকের মাধ্যমে দরিদ্র নারীদের ক্ষুদ্র ঋণ দেওয়ার মধ্য দিয়ে দেখেছি, মানুষ সীমাহীন সম্ভাবনার অধিকারী। শুধু দরকার সঠিক সুযোগ দেওয়ার।”

ভবিষ্যৎ রচনার ছয় পরামর্শ

ভবিষ্যতের জন্য ড. ইউনূস ছয়টি মৌলিক পরামর্শ দেন—

১. আস্থাভিত্তিক আন্তর্জাতিক সম্পর্ক গড়ে তোলা
২. সামাজিক ব্যবসার ওপর জোর দেওয়া
৩. জলবায়ু সহিষ্ণু উন্নয়ন মডেল তৈরি
৪. যুব সমাজের নেতৃত্ব বিকাশ
৫. অর্থনৈতিক বৈষম্য কমানো
৬. শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের জন্য সক্রিয় উদ্যোগ গ্রহণ

আস্থা, সাহস ও সহযোগিতার আহ্বান

ড. ইউনূস বলেন, “আমাদের চারপাশের ঝঞ্ঝা দেখে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। বরং এটিকে আহ্বান হিসেবে দেখা উচিত—পুনর্বিবেচনা ও পুনর্গঠনের জন্য।”

“আসুন আমরা ভয় দ্বারা নয়, উদ্দেশ্য দ্বারা পরিচালিত হই। উন্নত বিশ্বের কল্পনা করতে শিখি, একে অপরকে বিশ্বাস করি, কারণ আমাদের করতে হবে বলে নয়—আমরা চাই বলেই করি। এশিয়ার ভবিষ্যৎ একসঙ্গে লিখতে পারি আমরা, বাংলাদেশ ও জাপান।”

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button