ভিন্ন এক বাণিজ্যযুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র-চীন

দুই দশক আগেও চীন ছিল বিশ্ব বাণিজ্যে তুলনামূলকভাবে দুর্বল একটি পক্ষ। অথচ মাত্র বিশ বছরে নাটকীয়ভাবে বদলে গেছে সেই চিত্র। যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যিক আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে চীন উঠে এসেছে নতুন এক অর্থনৈতিক পরাশক্তি হিসেবে। আর এই পরিবর্তনের পেছনে রয়েছে বিশাল রপ্তানি প্রবৃদ্ধি, শিল্প উৎপাদনের বিস্তার এবং প্রযুক্তিতে দ্রুত অগ্রগতি।
চীনের উত্থান এবং যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগ
২০০০ সালে যেখানে চীনের বাণিজ্যিক পরিধি ছিল যুক্তরাষ্ট্রের এক-চতুর্থাংশ, সেখানে ২০২৪ সাল নাগাদ যুক্তরাষ্ট্রের দেড় গুণ বেড়ে দাঁড়ালেও চীনের বাণিজ্য বেড়েছে ১১ গুণ। এর ফলে চীনের বার্ষিক বাণিজ্যের পরিমাণ এখন দাঁড়িয়েছে প্রায় ৬.৫ ট্রিলিয়ন ডলারে, যা অনেক দেশের সম্মিলিত অর্থনীতির চেয়েও বড়।
চীনের এই অগ্রগতিকে কেন্দ্র করে উদ্বেগে পড়েছে যুক্তরাষ্ট্র। কারণ ২০২৪ সালে যুক্তরাষ্ট্র চীন থেকে আমদানি করেছে প্রায় ৪৬৩ বিলিয়ন ডলারের পণ্য, যেখানে নিজস্ব রপ্তানির পরিমাণ মাত্র ১৯৯ বিলিয়ন ডলার। এই বাণিজ্য ঘাটতি দূর করতে বাইডেন প্রশাসন নতুন করে শুল্ক আরোপের সিদ্ধান্ত নেয়—যার হার সর্বোচ্চ ১২৫ শতাংশ।
পাল্টা শুল্কের প্রতিক্রিয়া
চীনও বসে থাকেনি। পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে ৮৪ শতাংশ হারে শুল্ক আরোপ করে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানিকৃত পণ্যে। এতে করে উভয় দেশের ভোক্তাদের জন্যই ব্যয় বেড়ে যাওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মোবাইল ফোন, ইলেকট্রনিক্স, গাড়ি, খেলনা, গৃহস্থালী সামগ্রী, ফার্নিচারসহ বিভিন্ন খাতে দাম বেড়ে যেতে পারে ৬৪ শতাংশ পর্যন্ত। খাদ্য ও কৃষি পণ্যে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ মূল্যবৃদ্ধির সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।
অন্যদিকে, চীন যেসব খাতে যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভরশীল—সেগুলো হলো সেমিকন্ডাক্টর, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI), জ্বালানি তেল এবং ইস্পাত। এসব খাতেও শতভাগ পর্যন্ত মূল্যবৃদ্ধির শঙ্কা রয়েছে। এতে করে চীনের উৎপাদন খরচ বেড়ে যাবে এবং বৈশ্বিক সরবরাহ চেইন নতুন করে বিঘ্নিত হতে পারে।
প্রযুক্তি ও উৎপাদনে প্রতিযোগিতা
বাইডেন প্রশাসন ইতোমধ্যে সেমিকন্ডাক্টর ও প্রযুক্তি খাতে এক ট্রিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে। তবে বাস্তবতা হলো, এই বিনিয়োগের সুফল পেতে আরও অন্তত ৩ বছর সময় লাগবে। কারণ নতুন প্রযুক্তি শিল্প গড়তে সময়, শ্রম ও অবকাঠামোগত প্রস্তুতি দরকার।
এদিকে, ট্রাম্পের ‘মেইক আমেরিকা গ্রেট এগেইন’ (MAGA) স্লোগানের ক্যাপ বানাতেও খরচ বাড়ছে ৩৪ শতাংশ, যা একটি প্রতীকী উদাহরণ হিসেবে দেখা হচ্ছে যে কীভাবে এই বাণিজ্য যুদ্ধ সামগ্রিক উৎপাদন ও রপ্তানি খাতকে প্রভাবিত করছে।
অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে ধসের শঙ্কা
প্রভাবশালী আর্থিক সংস্থা গোল্ডম্যান শেকস পূর্বাভাস দিয়েছে, এভাবে চলতে থাকলে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি ৬৫ শতাংশ পর্যন্ত সংকুচিত হতে পারে। অপরদিকে, মুডিস জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রবৃদ্ধি কমে যেতে পারে ৪৫ শতাংশ। এই সংকোচন শুধু অভ্যন্তরীণ বাজারেই নয়, প্রভাব ফেলবে বৈশ্বিক অর্থনীতিতেও।
বাণিজ্য বিশ্লেষকদের মতে, ৩০ বছর আগে বৈশ্বিক পণ্য উৎপাদনে চীনের অংশ ছিল মাত্র ৩ শতাংশ। এখন তা দাঁড়িয়েছে সর্বোচ্চ স্থানে। আর যুক্তরাষ্ট্র সেই বাজারে হারিয়েছে প্রায় ৬ শতাংশ অংশ। যার প্রভাব পড়ছে তাদের অভ্যন্তরীণ শিল্পে।
ভবিষ্যৎ দৃষ্টিভঙ্গি: বন্ধুত্ব না প্রতিদ্বন্দ্বিতা?
বিশ্বায়নের যুগে এই ধরনের বাণিজ্য যুদ্ধ দীর্ঘমেয়াদে কেউই জিততে পারে না। বরং এতে বিপদ বাড়ে উভয়পক্ষের। একদিকে ভোক্তাদের জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়ে, অন্যদিকে বিনিয়োগে স্থবিরতা আসে।
চীন ও যুক্তরাষ্ট্র—উভয় দেশের জন্যই এখন প্রয়োজন কৌশলগত সংলাপ ও বাণিজ্যিক ভারসাম্য আনা। এই মুহূর্তে সংঘাত নয়, দরকার সহযোগিতা। নতুবা বৈশ্বিক অর্থনীতির ওপর এর নেতিবাচক প্রভাব হতে পারে সুদূরপ্রসারী।
বিশ্বের দুই বৃহৎ অর্থনীতি যদি এই দ্বন্দ্ব প্রশমিত না করে, তাহলে শুধু তাদেরই নয়, ক্ষতিগ্রস্ত হবে উন্নয়নশীল দেশগুলোও—যারা এই দুই দেশের বাজারে প্রবলভাবে নির্ভরশীল। ফলে এই বাণিজ্য যুদ্ধ আর শুধু যুক্তরাষ্ট্র-চীনের সীমাবদ্ধ থাকছে না, এটি এখন এক বৈশ্বিক সংকটের ইঙ্গিতবাহী নতুন মাত্রার বাণিজ্য যুদ্ধ।