গাজায় মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রতিবাদে ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করল আইরিশ বিশ্ববিদ্যালয়
আয়ারল্যান্ডের প্রখ্যাত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ট্রিনিটি কলেজ ডাবলিন ইসরায়েলের সঙ্গে সব প্রাতিষ্ঠানিক সম্পর্ক ছিন্ন করার ঘোষণা দিয়েছে। গাজা উপত্যকায় ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরায়েলি অভিযানে চলমান মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রতিবাদে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
বিশ্ববিদ্যালয়টির বোর্ড সদস্যরা এক ই-মেইলে শিক্ষার্থীদের জানান, তাঁরা এ বিষয়ে একটি বিশেষ টাস্কফোর্সের সুপারিশ গ্রহণ করেছেন। সুপারিশ অনুযায়ী, ইসরায়েল রাষ্ট্র, ইসরায়েলি বিশ্ববিদ্যালয় এবং দেশটির ভিত্তিক কোম্পানির সঙ্গে সমস্ত প্রাতিষ্ঠানিক সম্পর্ক ছিন্ন করা হবে।
মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে স্পষ্ট অবস্থান
বোর্ডের চেয়ারম্যান পল ফারেল স্বাক্ষরিত সেই ই-মেইলে স্পষ্ট বলা হয়, এই সিদ্ধান্ত তখন পর্যন্ত কার্যকর থাকবে, যতক্ষণ না গাজায় আন্তর্জাতিক আইন ও মানবাধিকার লঙ্ঘন বন্ধ হচ্ছে। খবর সংস্থা এএফপি এই ই-মেইলের একটি কপি সংগ্রহ করেছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে আরও জানানো হয়, গত বছর মধ্য ডাবলিনে অবস্থিত ট্রিনিটি কলেজ ক্যাম্পাসে গাজা পরিস্থিতির প্রতিবাদে শিক্ষার্থীরা পাঁচ দিনের অবরোধ চালিয়েছিল। এরই প্রেক্ষিতে কর্তৃপক্ষ একটি টাস্কফোর্স গঠন করে এবং পরবর্তীতে সেই টাস্কফোর্সের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।
সুনির্দিষ্ট নিষেধাজ্ঞা ও পদক্ষেপ
ট্রিনিটি কলেজ ডাবলিনের বোর্ড যেসব পদক্ষেপ নিচ্ছে, তার মধ্যে রয়েছে:
- ইসরায়েলি কোম্পানিতে বিনিয়োগ প্রত্যাহার।
- ইসরায়েলভিত্তিক কোনো কোম্পানির সঙ্গে ভবিষ্যতে কোনো বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপন না করা।
- ইসরায়েলের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে শিক্ষার্থী বিনিময় কর্মসূচি স্থগিত।
- যেসব গবেষণা প্রকল্পে ইসরায়েলি অংশগ্রহণ রয়েছে, সেখানে ট্রিনিটি কলেজ অংশ নেবে না।
বিশ্ববিদ্যালয় জানিয়েছে, ভবিষ্যতে ইসরায়েলি বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে নতুন কোনো গবেষণা প্রকল্পে যোগদান বা অনুমোদনের প্রস্তাব দেওয়া হবে না।
ইরাসমুস প্লাস চুক্তির ভবিষ্যৎ
বর্তমানে ইউরোপীয় ইউনিয়নের শিক্ষা বিনিময় কর্মসূচি ইরাসমুস প্লাস এর অধীনে ট্রিনিটি কলেজের ইসরায়েলের দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে অংশীদারিত্ব রয়েছে। একটি হলো তেল আবিবের উপকণ্ঠের বার ইলান বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে, যার চুক্তির মেয়াদ শেষ হবে ২০২৬ সালের জুলাইয়ে। আরেকটি হলো হিব্রু ইউনিভার্সিটি অব জেরুজালেমের সঙ্গে, যার মেয়াদ শেষ হবে ২০২৫ সালের জুলাইয়ে।
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্র জানিয়েছে, এসব চুক্তি মেয়াদ শেষ হওয়ার পর আর নবায়ন করা হবে না, এবং নতুন কোনো চুক্তি করা হবে না।
আয়ারল্যান্ডের সরব ভূমিকা
গাজায় ইসরায়েলের সামরিক অভিযান শুরু হওয়ার পর থেকেই আয়ারল্যান্ড সরকার ও সাধারণ জনগণ ফিলিস্তিনের প্রতি একটানা সংহতি প্রকাশ করে আসছে। একাধিক জনমত জরিপে দেখা গেছে, আয়ারল্যান্ডে ফিলিস্তিনিদের প্রতি ব্যাপক জনসমর্থন রয়েছে।
২০২৪ সালের মে মাসে আয়ারল্যান্ড সরকার ফিলিস্তিনকে একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। সে সময় আরও কয়েকটি ইউরোপীয় দেশ একই ধরনের স্বীকৃতি দেয়।
পরবর্তীতে, আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (আইসিজে) ইসরায়েলের বিরুদ্ধে দক্ষিণ আফ্রিকার আনা গণহত্যার অভিযোগের মামলায় আইরিশ সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে পক্ষভুক্ত হয়।
ইসরায়েলের প্রতিক্রিয়া ও কূটনৈতিক টানাপোড়েন
আয়ারল্যান্ডের কঠোর অবস্থানের প্রেক্ষিতে ইসরায়েল তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। ২০২৪ সালের ডিসেম্বর মাসে ইসরায়েলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী গিদিয়ন সার ‘চরম ইসরায়েলবিরোধী নীতি গ্রহণের’ অভিযোগ তুলে ডাবলিনে ইসরায়েলি দূতাবাস বন্ধ করে দেওয়ার নির্দেশ দেন।
ইসরায়েলি নেতারা অবশ্য গাজায় মানবাধিকার লঙ্ঘন, গণহত্যা ও আন্তর্জাতিক আইনের অভিযোগগুলো কঠোরভাবে অস্বীকার করে আসছেন। তাঁদের দাবি, দেশটির প্রতিটি সামরিক পদক্ষেপ ‘নিরাপত্তা ও সন্ত্রাসবাদ প্রতিরোধে’ পরিচালিত হচ্ছে।
আন্তর্জাতিকভাবে নজিরবিহীন পদক্ষেপ
ট্রিনিটি কলেজ ডাবলিনের এই সিদ্ধান্ত ইউরোপের অন্য অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য একটি শক্ত বার্তা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। এটি শুধু শিক্ষাক্ষেত্রে নয়, বরং আন্তর্জাতিক নীতিমালার আলোচনায়ও নতুন মাত্রা যোগ করেছে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এই সিদ্ধান্ত অন্যান্য ইউরোপীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও পাবলিক ইন্সটিটিউশনের মধ্যেও একটি চেইন রিঅ্যাকশন সৃষ্টি করতে পারে, যারা মানবাধিকার ও আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনের বিষয়ে ক্রমাগত সরব ভূমিকা পালন করছে।
ট্রিনিটি কলেজ ডাবলিনের এই ঘোষণা ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাত ইস্যুতে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর নৈতিক ও রাজনৈতিক অবস্থান প্রকাশের ক্ষেত্রে একটি দৃষ্টান্ত হয়ে উঠেছে। এটি শুধু একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রতিবাদ নয়, বরং সারা বিশ্বের তরুণ প্রজন্মের পক্ষে এক দৃঢ় বার্তা: মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে নীরব থাকা নয়, বরং সরব অবস্থানই আগামী ন্যায়ের পথে নিয়ে যেতে পারে।
