‘দেশে কোনো ভিক্ষুক নেই’ দাবি করে তোপের মুখে পদত্যাগ করলেন কিউবার শ্রমমন্ত্রী

কিউবার শ্রমমন্ত্রী মার্টা এলেনা ফেইতো-কাব্রেরা সম্প্রতি এক বিতর্কিত মন্তব্য করে দেশ-বিদেশের সমালোচনার মুখে পড়েছেন। তিনি দাবি করেন, “কিউবায় কোনো ভিক্ষুক নেই।” এই মন্তব্যের পরই তিনি পদত্যাগের announcements করতে বাধ্য হন। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি নিউজ এই তথ্য প্রকাশ করেছে।
‘কিউবায় ভিক্ষুক নেই’ – একটি বিতর্কিত বক্তব্য
মার্টা এলেনা ফেইতো-কাব্রেরা কিউবার সংসদীয় অধিবেশনে বলেন, দেশের গলি-গলি বা রাস্তায় যারা আবর্জনা খোঁজে, তাদের ভিক্ষুক বলা যায় না। তার মতে, তারা স্বেচ্ছায় “সহজ অর্থ উপার্জনের” জন্য এমন কাজ করে। তিনি জানান, “আমাদের দেশে ভিক্ষুক নেই, যারা কাজ করছে তারা নিজেরাই কাজ করছে।”
তবে, এই বক্তব্য কিউবার অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক মহলে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়ে। কারণ কিউবা দীর্ঘদিন ধরে তীব্র অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে রয়েছে, যেখানে সাধারণ মানুষের জীবনে দারিদ্র্য ও অভাব চোখে পড়ার মতো। একেবারে অপ্রতিরোধ্য এই সংকটের মধ্যে অনেকেই ‘ভিক্ষুক’ বা সাহায্যের জন্য পথে নামেন বলে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।
কিউবার অর্থনৈতিক সংকট ও দারিদ্র্যের বাস্তবতা
কিউবা দীর্ঘদিন ধরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা এবং করোনা মহামারির প্রভাবে মারাত্মক অর্থনৈতিক সংকটের মুখোমুখি। তেলের অভাব, খাদ্য সংকট, ও সাধারণ পণ্যের দাম আকাশছোঁয়া হওয়ায় দেশের নিম্ন আয়ের মানুষজন জীবিকার তাগিদে রাস্তায় নামেন। এদের মধ্যে অনেকেই আবর্জনা থেকে পুনর্ব্যবহারযোগ্য জিনিস সংগ্রহ করে জীবিকা নির্বাহ করেন।
কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে কখনওই ভিক্ষুকের সংখ্যা নিয়ে স্পষ্ট তথ্য প্রকাশ করা হয় না। আর এই অবস্থায় শ্রমমন্ত্রীর বক্তব্যকে অনেকেই অবমূল্যায়নমূলক ও জনগণের প্রতি অপমানজনক বলে অভিহিত করেছেন।
পদত্যাগের পেছনে বিরোধী দলের চাপ ও জনমত
মার্টা এলেনা ফেইতো-কাব্রেরার এই বিতর্কিত বক্তব্যের পর কিউবার বেশ কয়েকজন বুদ্ধিজীবী, কর্মী এবং রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব একত্রিত হয়ে তাকে অপসারণের দাবি জানান। তারা এক যৌথ চিঠিতে লিখেন, তার মন্তব্য কিউবান জনগণের প্রতি ‘এক ধরনের অবমাননা’।
এছাড়া দেশের বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ পেদ্রো মনরিয়াল তাঁর সোশ্যাল মিডিয়ায় লেখেন, “যদি দেশে ভিক্ষুক নেই, তাহলে নিশ্চয় কিছু মানুষ ‘মন্ত্রী’ সেজেও বসে আছেন।” এটি ছিল এক ধরনের বিদ্রূপাত্মক প্রতিক্রিয়া।
এরপর কিউবা প্রেসিডেন্ট মিগেল ডিয়াজ-ক্যানেল দ্রুত প্রতিক্রিয়া জানিয়ে মার্টার পদত্যাগের নির্দেশ দেন। ওই দিনই তিনি পদ থেকে সরে দাঁড়ান।
আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম ও বিশ্লেষকদের মন্তব্য
বিবিসি নিউজ, আল জাজিরা, ও রয়টার্সসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম এই ঘটনা গুরুত্ব সহকারে রিপোর্ট করেছে। তারা বলেছেন, কিউবার অর্থনৈতিক সংকটের পেছনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘদিনের নিষেধাজ্ঞা এবং সরকারের অভ্যন্তরীণ দুর্বল নীতি একটি বড় ভূমিকা পালন করেছে।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, সরকারিভাবে ভিক্ষুকের অস্তিত্ব অস্বীকার করা বাস্তবতা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার ছাপ দেয়। এ সময় নাগরিকদের জীবনের কঠিন বাস্তবতা লুকিয়ে রাখা সম্ভব নয়।
কিউবার অর্থনৈতিক সংকটের পটভূমি
কিউবায় গত কয়েক বছর ধরে অর্থনীতির অবনতি এবং মুদ্রাস্ফীতি বৃদ্ধি পাচ্ছে। খাদ্যের দাম বার্ষিক প্রায় ৩০% বৃদ্ধি পেয়েছে এবং প্রয়োজনীয় ওষুধের অভাবও দেখা দিয়েছে। এই সংকটের কারণে বহু পরিবার জীবিকা নির্বাহের জন্য রাস্তায় নামতে বাধ্য হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, কিউবার সরকার যদি জনগণের বাস্তব চাহিদা ও সমস্যাগুলোকে স্বীকার করে ঠিকঠাক সমাধান না দেয়, তবে এই সংকট আরও গভীরতর হবে।
ভবিষ্যৎ কিউবার রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতি
মার্টা এলেনা ফেইতো-কাব্রেরার পদত্যাগ কেবল একটি ইঙ্গিত মাত্র। এটি কিউবার সরকারকে জনমতের প্রতি বেশি সংবেদনশীল হতে বাধ্য করেছে। তবে দেশটিতে অর্থনৈতিক ও সামাজিক সংস্কারের জন্য বড় ধরনের পরিবর্তন এখনও অনিশ্চিত।
বিশ্লেষকরা বলছেন, কিউবার সরকারকে যদি সত্যিকার অর্থে জনগণের কল্যাণে কাজ করতে হয়, তাহলে তাদের দরিদ্র ও বিপন্ন জনগোষ্ঠীর প্রতি অধিকতর দৃষ্টি দেওয়া জরুরি। আর তা না হলে রাজনৈতিক উত্তেজনা ও সামাজিক অস্থিরতা বেড়ে যাওয়া খুবই সম্ভব।
সংক্ষেপে
- কিউবার শ্রমমন্ত্রী মার্টা এলেনা ফেইতো-কাব্রেরা দাবি করেন, “দেশে কোনো ভিক্ষুক নেই।”
- এই বক্তব্যে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়ে তিনি পদত্যাগ করেন।
- কিউবা দীর্ঘদিন ধরে অর্থনৈতিক সংকট ও দারিদ্র্যের মধ্যে রয়েছে।
- বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও কর্মীরা তার অপসারণ দাবি করেন এবং মন্তব্যকে ‘জনগণের অবমাননা’ বলে অভিহিত করেন।
- কিউবার প্রেসিডেন্ট মিগেল ডিয়াজ-ক্যানেল দ্রুত পদত্যাগের নির্দেশ দেন।
- আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম এবং বিশ্লেষকরা কিউবার সংকটের পেছনে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা এবং সরকারের দুর্বল নীতির কথা তুলে ধরেন।
- আগামীতে কিউবার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংস্কারে জনমতের গুরুত্ব বাড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
কীভাবে এই সংবাদ আমাদের শেখায়?
এ ঘটনার মাধ্যমে দেখা যায়, একটি দেশের গভীর অর্থনৈতিক সংকটকে রাজনীতির মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা কতটা ঝুঁকিপূর্ণ। সৎ ও স্পষ্ট তথ্য প্রকাশ, জনগণের সমস্যা বোঝা এবং দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ ছাড়া কোনও দেশ তার নাগরিকদের বিশ্বাস ও সম্মান ধরে রাখতে পারে না।