নাসার সঙ্গে ‘আর্টেমিস অ্যাকর্ডস’ চুক্তি সই করল বাংলাদেশ

বাংলাদেশ এক নতুন যুগে পদার্পণ করেছে মহাকাশ গবেষণার অঙ্গনে। যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার নেতৃত্বাধীন ‘আর্টেমিস অ্যাকর্ডস’ চুক্তিতে স্বাক্ষর করার মাধ্যমে বাংলাদেশ হয়ে উঠেছে বিশ্বের ৫৪তম দেশ, যারা শান্তিপূর্ণ ও অসামরিক মহাকাশ অনুসন্ধানে নিজেদের সম্পৃক্ত করেছে।
এটি শুধুমাত্র একটি কূটনৈতিক সাফল্য নয়, বরং দেশের প্রযুক্তিগত সক্ষমতা, বৈজ্ঞানিক উদ্ভাবন এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতার প্রতি প্রতিশ্রুতির প্রতিফলনও বটে।
চুক্তি স্বাক্ষরের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হয় ঢাকায়, বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) নির্বাহী চেয়ারম্যান চৌধুরী আশিক মাহমুদ বিন হারুন এবং বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন দূতাবাসের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স ট্রেসি অ্যান জ্যাকবসনের উপস্থিতিতে। অনুষ্ঠানে প্রতিরক্ষা সচিব মো. আশরাফ উদ্দিন বাংলাদেশের পক্ষ থেকে চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন।
আর্টেমিস অ্যাকর্ডস: শান্তিপূর্ণ মহাকাশ ব্যবস্থাপনার পথপ্রদর্শক
২০২০ সালের অক্টোবরে প্রতিষ্ঠিত আর্টেমিস অ্যাকর্ডস মূলত এক ধরনের অ-বাধ্যতামূলক আন্তর্জাতিক কাঠামো যা জাতিসংঘের ‘আউটার স্পেস ট্রিটি’, ‘অ্যাস্ট্রোনট রেসকিউ এগ্রিমেন্ট’ এবং ‘স্পেস অবজেক্ট রেজিস্ট্রেশন কনভেনশন’-এর নীতিমালার ভিত্তিতে গঠিত হয়েছে। এই চুক্তির উদ্দেশ্য হলো মহাকাশ অনুসন্ধানে শান্তি, স্বচ্ছতা, সহযোগিতা এবং টেকসই ব্যবস্থার মাধ্যমে একটি নতুন আন্তর্জাতিক মানদণ্ড প্রতিষ্ঠা করা।
চুক্তির অন্যতম মূলনীতিগুলোর মধ্যে রয়েছে:
- মহাকাশে স্বচ্ছতা বজায় রাখা
- সংঘর্ষ এড়াতে তথ্য বিনিময়
- মহাকাশ সম্পদের দায়িত্বশীল ব্যবহার
- মহাকাশ ঐতিহ্য সংরক্ষণ
বাংলাদেশের অংশগ্রহণ: সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত
চুক্তিতে স্বাক্ষর করে বাংলাদেশ আজ বিশ্বব্যাপী এক সম্মানজনক জোটের অংশ হলো। এই জোটে ইতিমধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, জাপান, ভারত, অস্ট্রেলিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ বিশ্বের ৫০টিরও বেশি উন্নত ও উদীয়মান দেশ যুক্ত হয়েছে। বাংলাদেশের এই অংশগ্রহণ কেবল আন্তর্জাতিক মর্যাদা বৃদ্ধি করে না; বরং দেশের বৈজ্ঞানিক, প্রযুক্তিগত ও অর্থনৈতিক ভবিষ্যতের পথও প্রসারিত করে।
চুক্তি স্বাক্ষরের পর প্রতিরক্ষা সচিব মো. আশরাফ উদ্দিন বলেন, “আর্টেমিস অ্যাকর্ডস হলো একটি নির্দেশিকা যা মহাকাশের শান্তিপূর্ণ, নিরাপদ ও টেকসই ব্যবহারে সহায়ক হবে। বাংলাদেশ দীর্ঘদিন ধরে আন্তর্জাতিক নিয়মনীতি মেনে মহাকাশ গবেষণায় কাজ করে আসছে এবং এই চুক্তিতে স্বাক্ষরের মাধ্যমে সেই প্রতিশ্রুতি আরও জোরালো হলো।”
প্রযুক্তি স্থানান্তর ও বৈজ্ঞানিক সহযোগিতা
নাসা ও অন্যান্য মহাকাশ গবেষণা সংস্থার সঙ্গে অংশীদারিত্বের ফলে বাংলাদেশ একাধিক ক্ষেত্রে লাভবান হতে পারে। যেমন:
- উন্নত স্যাটেলাইট প্রযুক্তি ব্যবহারের সুযোগ
- বৈজ্ঞানিক গবেষণায় যৌথ অংশগ্রহণ
- দুর্যোগ পূর্বাভাস ও জলবায়ু মনিটরিং প্রযুক্তি উন্নয়ন
- বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের জন্য নাসার বৃত্তি ও প্রশিক্ষণ প্রোগ্রামে অংশগ্রহণ
স্পারসোর মতো প্রতিষ্ঠানগুলো পৃথিবী পর্যবেক্ষণ, কৃষি-জলবায়ু বিশ্লেষণ, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা এবং টেলিকম খাতে স্যাটেলাইট ডেটা ব্যবহার করে অনেক বেশি কার্যকরভাবে অবদান রাখতে পারবে।
শিক্ষা ও মানবসম্পদ উন্নয়ন
এই চুক্তির মাধ্যমে দেশের শিক্ষার্থী, গবেষক ও বিজ্ঞানীদের জন্যও তৈরি হয়েছে নতুন সম্ভাবনা। শিক্ষার্থীরা নাসার বিভিন্ন স্কলারশিপ, এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রাম এবং প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণের সুযোগ পাবে। এতে করে ভবিষ্যতে বাংলাদেশ থেকে আন্তর্জাতিক মানের মহাকাশ বিজ্ঞানী ও প্রকৌশলী তৈরি হওয়া সহজ হবে।
চৌধুরী আশিক মাহমুদ বলেন, “এই স্বাক্ষরের মাধ্যমে বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে মহাকাশ গবেষণায় একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা হলো। দেশের তরুণ বিজ্ঞানীরা এখন বৈশ্বিক গবেষণা কাঠামোর সঙ্গে কাজ করতে পারবে।”
বৈশ্বিক পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের অগ্রগতি
বিশ্বব্যাপী যে কয়টি দেশ মহাকাশ অনুসন্ধানে সক্রিয়, তাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ এখন ‘আর্টেমিস অ্যাকর্ডস’-এর আওতায় এসেছে। এতে করে মহাকাশকে যুদ্ধ ও প্রতিযোগিতার পরিবর্তে শান্তিপূর্ণ ও যৌথ উন্নয়নের ক্ষেত্র হিসেবে গড়ে তোলার একটি অভিন্ন লক্ষ্য প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে।
২০২৫ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত ৫৩টি দেশ এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে। বাংলাদেশের এই উদ্যোগ আন্তর্জাতিক মহলে মহাকাশ প্রযুক্তি ও কূটনীতিতে দেশের অবস্থানকে দৃঢ় করেছে।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ও সম্ভাবনা
এই চুক্তির মাধ্যমে সরকার মহাকাশ প্রযুক্তিকে দেশের উন্নয়নের অংশ হিসেবে ব্যবহার করার পরিকল্পনা করছে। যেমন:
- নিজস্ব স্যাটেলাইট নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণ
- দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় রিমোট সেনসিং প্রযুক্তি
- কৃষি, বন, ও পরিবেশ পর্যবেক্ষণ
- প্রযুক্তি ও ডেটা সিকিউরিটি নিশ্চিতকরণ
প্রতিরক্ষা সচিব আশরাফ উদ্দিন উল্লেখ করেন, “নাসার সঙ্গে সহযোগিতার ফলে আমরা মহাকাশ খাতে প্রযুক্তিগত সক্ষমতা বাড়াতে পারব। এটি আমাদের জাতীয় নিরাপত্তা, উন্নয়ন এবং বৈজ্ঞানিক গবেষণাকে আরও শক্তিশালী করবে।”
উপসংহার
বাংলাদেশের পক্ষে নাসার সঙ্গে ‘আর্টেমিস অ্যাকর্ডস’ চুক্তিতে স্বাক্ষর করা নিঃসন্দেহে একটি ঐতিহাসিক মাইলফলক। এটি দেশের মহাকাশ গবেষণাকে বৈশ্বিক মানচিত্রে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছে এবং ভবিষ্যৎ প্রযুক্তি ও অর্থনীতিতে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করেছে।
এই চুক্তি শুধু এককালীন অর্জন নয়, বরং এক নতুন অভিযাত্রার সূচনা; যেখানে বাংলাদেশ বৈশ্বিক মহাকাশ সম্প্রদায়ের দায়িত্বশীল ও শক্তিশালী অংশীদার হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে।