বিশ্ব

ভারতের পুশ-ইন বেড়ে সীমান্তে আতঙ্ক, আটক ৩৭০ জন

গত কয়েক সপ্তাহে দেশের সীমান্তবর্তী জেলাগুলোয় ভারত থেকে অবৈধ পুশ-ইন এর ঘটনা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। প্রায় প্রতিদিনই বিজিবি (বাংলাদেশ সীমান্তগোপন নিরাপত্তা বাহিনী) ও বিএসএফ (ভারতীয় সীমান্তরক্ষা বাহিনী) যৌথ কর্মসূচিতে আটক হচ্ছে পুশ-ইনের উদ্দেশ্যে ঠেলে আসা বাংলাদেশি, রোহিঙ্গা এবং ইউএনএইচসিআরের কার্ডধারী শরণার্থীরা। এতে সীমান্তবর্তী এলাকার নাগরিক ও উপকূলবর্তী জনপদের মানুষদের মধ্যে ব্যাপক আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে।

পুশ-ইন: কী ও কেন?

পুশ-ইন বলতে বোঝানো হয় সীমান্তের এক পাশে (ভারত) জমেই থাকা লোকজনকে রাতের অন্ধকার কিংবা কোনো অস্বচ্ছ বিধানে অনুপ্রবেশ করিয়ে বাংলাদেশে ছেড়ে দেওয়াকে। এই অপ্রত্যাশিত ভীড়ে সীমান্ত পাহারা দেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে, আর বাংলাদেশের জনগণ ও নিরাপত্তা বাহিনী উভয়ে অপরিকল্পিত অনুপ্রবেশ থেকে বিপদে পড়ছেন।

সীমান্তজুড়ে আতঙ্কের ওপার-এই সংখ্যা

চলতি মাসে আটটা জেলা দিয়ে মোট ৩৭০ জন পুশ-ইন করা হয়েছে:

  • খাগড়াছড়ি: ৭৩
  • কুড়িগ্রাম: ৪৪
  • সিলেট: ২৩
  • ঝিনাইদহ: ২২
  • ঠাকুরগাঁও: ১৭
  • মৌলভীবাজার: ১৫
  • পঞ্চগড়: ১১
  • চুয়াডাঙ্গা: ১০

উল্লেখ্য, এই আট জেলার অন্যান্য স্থানেও অনিচ্ছাকৃত অনুপ্রবেশের ঘটনা ঘটছে, তবে শরীয়ত মোতাবেক জরুরি প্রক্রিয়ায় ফেরত পাঠানোর সংখ্যা ছাপিয়ে গেছে এমন প্রায় অগ্রাহ্য “গুপ্ত” প্রবেশীর সংখ্যা।

প্রধান হটস্পট: কুড়িগ্রাম, ঝিনাইদহ, ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড়, খাগড়াছড়ি

কুড়িগ্রাম: চোরাচালান ও মাদক – পুশ-ইনের নতুন রুট

কুড়িগ্রামের সোনাহাট, ভাওয়ালকুড়িচিলমারী সীমান্ত এলাকা পুরনো থেকেই মাদক ও পাচার রুট হিসেবে পরিচিত। এখানে ৫০–৬০ কিঃমিঃ অংশে কোনো কাঁটাতারের বেড়া নেই। ফলে রাতের বেলা পুশ-ইন অতিসংবেদনশীল হয়ে পড়েছে।

  • মহম্মদ আলী, একটি সীমান্তবর্তী গ্রাম থেকে জানান, “রাতের আধারে ৩০–৪০ জন লোক একদল করে বাংলাদেশ ঢুকতে দেখেছি; কেউ তাদের বাড়ির ঠিকানা বলতে পারেনি।”

ঠাকুরগাঁও ও ঝিনাইদহ: পুশ-ইন ও মানবপাচার

ঠাকুরগাঁওয়ের বালিয়াডাঙ্গী ও ঝিনাইদহের আদ্রা সীমান্তে মানবপাচারশিপায়ি পুশ-ইন বাড়ায় স্থানীয়রা আতঙ্কিত। রোহিঙ্গাইউএনএইচসিআরের কার্ডধারী অনেকে নীরবে আসার চেষ্টা করছেন।

পঞ্চগড় ও খাগড়াছড়ি: পাহাড়ি-নদীপথে ফাঁক

পঞ্চগড়ের হোলাহাটি, খাগড়াছড়ির টেকনাফ-বিলাইছড়ি সীমান্ত অবলম্বনে নদীমাতৃক পথও পান্ডা-স্বপ্ন দেখাচ্ছে পাচারকারীদের।

ব্যক্তিগত কাহিনি: মামুদ উল্লাহ ও রোমানা বেগম

মিয়ানমারে সংঘর্ষে ঘরভাঙা দম্পতি মামুদ উল্লাহরোমানা বেগম ভারতে আশ্রয় নিয়েছিলেন।

  • ৭ মে রাতে ভাওয়ালকুড়ি সীমান্ত দিয়েই তাদের পরিবারের ৫ জনকে পুশ-ইন করে বিএসএফ।
  • রাত তিন ঘণ্টা ধরে গাড়িতে সংরক্ষণ, তারপর নির্জন রাতে সীমান্ত হেঁটে পেরিয়ে আসে।
  • কুড়িগ্রাম-২২ বিজিবি ক্যাম্পের সুবেদার আইয়ুব হোসেন বলেন, “দু’ঘণ্টা চোখ বেঁধে হেঁটে এসেছে; পরে খবর পেয়ে তাদের আটক করা হয়।”

মামুদ উল্লাহ বলেন,

“আমরা অন্ধকারে হেঁটে অত্যন্ত ভয় পেয়ে ছিলাম; কয়েক দিন ধরে কোনো খাবার পানিইনি।”

সরকারী ও বৈশ্বিক প্রতিক্রিয়া

সরকারের উদ্যোগ

  • বিজিবি মহাপরিচালক, মেজর জেনারেল আশরাফুজ্জামান সিদ্দিকী, বলেছেন: “সীমান্ত অতি বিস্তৃত, প্রতিটি পয়েন্ট পাহারা সম্ভব নয়; আনসার বাহিনী ও স্থানীয় জনসাধারণের সহায়তা চাই।”
  • স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা, লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন: “ভারত থেকে পুশ-ইন এলে যদি বাংলাদেশের নাগরিক থাকে, তাদের ফিরিয়ে নেওয়া যাবে না; তবে ভারতীয় নাগরিক ও রোহিঙ্গাদের আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়ায় ফেরত পাঠানো হবে।”

কূটনৈতিক বোঝাপড়া

  • বিষয়টি দূতাবাসিক চ্যানেলে আলোচনা হলেও কোনো স্থায়ী সমাধান হয়নি।
  • বিদেশ মন্ত্রণালয় ভারতের কূটনীতিক দফতরে লিখিত নোটিশ দিয়েছে, যে অবৈধ বাংলাদেশি থাকলে দ্রুত ফেরত পাঠাতে হবে।

আন্তর্জাতিক সংস্থা

  • রোহিঙ্গা সংস্থাসীমান্ত তত্ত্বাবধানকারী বলছে, “পুশ-ইন বাড়লে মানবপাচার, পাচার চক্র আরও সক্রিয় হবে; বাঁচতে গিয়ে অনেকেই বিপদে পড়বে।”

মানবপাচার ও নিরাপত্তা ঝুঁকি

অনিয়ন্ত্রিত পুশ-ইন একদিকে মানবপাচার এর নতুন রুট তৈরি করছে, অন্যদিকে সন্ত্রাস, আতঙ্ক, মাদক, চোরাচালান সক্রিয় করছে।

  • কাঁটাতার–হেটার–ক্যামouflage দিয়ে রাতের আধারে অনুপ্রবেশ।
  • স্থানীয় জুট শ্রমিক, জনৈক গৃহিণী, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী–সবাই আতঙ্কিত।
  • ফেলা পড়া গাড়ি, উদ্ভীষ্ক চিহ্ন ইত্যাদি সীমান্তবর্তী গ্রাম অস্বস্তির কারণ

কী করা উচিত?

  1. সীমান্ত নিরাপত্তা জোরদার
    • ড্রোনসিসিটিভি দিয়ে নজরদারি
    • কাঁটাতার বেড়া বাড়ানো ও সেন্সর স্থাপন
  2. স্থানীয় কমিউনিটি ইন্টেলিজেন্স
    • গ্রাম পুলিশআনসার সদস্য নিয়ে টহল
    • জনসাধারণের ২৪/৭ হটলাইনে তথ্য গ্রহণ
  3. কূটনৈতিক চাপ
    • ভারতীয় সীমান্তে সহজীকরণ নয়, জরুরী পুশ-ব্যাক নিশ্চিত করা
    • দু’দেশের নিরাপত্তা সন্মেলন
  4. মানবিক সহায়তা
    • আটক পুশ-ইনদের জন্য সুবিধাজনক শরণাশ্রম
    • আইনি সচেতনতাকাগজপত্র যাচাই ক্যাম্প

ভারত থেকে পুশ-ইন বাড়ার ফলে সীমান্তবর্তী বাংলাদেশের মানবিক, নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতি সংকটাক্রান্ত হয়ে উঠছে। সংকট মোকাবিলায় সরকারি পদক্ষেপ, সীমান্ত রক্ষণাবেক্ষণ শক্তিশালী করা এবং স্থানীয় জনপদকে সচেতন করা অপ্রারম্ভিক। অন্যথায়, আতঙ্ক, অপরাধ এবং মানবিক বিপর্যয় বাড়তে থাকে, যার ফল দারুণ ভয়াভহ হতে পারে।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button