গাজার পথে ত্রাণবাহী জাহাজ নিয়ে মানবাধিকার সংস্থা ফ্রিডম ফ্লোটিলা

গাজার অবরুদ্ধ জনপদের উদ্দেশ্যে আবারও রওনা হয়েছে মানবাধিকার সংস্থা ফ্রিডম ফ্লোটিলার ত্রাণবাহী জাহাজ। ‘ম্যাডলিন’ নামের এই জাহাজটি ইতালির কাতানিয়া বন্দর থেকে রোববার (১ জুন) যাত্রা শুরু করেছে। onboard রয়েছেন সুইডিশ পরিবেশ আন্দোলনকর্মী গ্রেটা থুনবার্গ, আইরিশ অভিনেতা লিয়াম কানিংহামসহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আগত আরও ১২ জন অ্যাক্টিভিস্ট। লক্ষ্য একটাই—গাজায় মানবিক সহায়তা পৌঁছানো এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করা এই অঞ্চলের মানবাধিকার লঙ্ঘনের চিত্রে।
মানবিক সহায়তা ও প্রতীকী প্রতিবাদ
‘ম্যাডলিন’ জাহাজটিতে রয়েছে খাদ্য, পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট, জরুরি ওষুধ, চিকিৎসা সরঞ্জাম, শিশুদের জন্য পুষ্টিকর খাবার, এবং নারীদের জন্য স্যানিটারি সামগ্রীসহ নানান জরুরি পণ্য। গাজার ২৩ লাখ জনগণের একটি বড় অংশ দীর্ঘদিন ধরে চরম খাদ্য ও চিকিৎসাসংকটে ভুগছে। ইসরায়েলি অবরোধের ফলে সেখানে পণ্য প্রবেশ অত্যন্ত সীমিত, এমন পরিস্থিতিতে এই উদ্যোগ অনেক বেশি তাৎপর্যপূর্ণ।
এছাড়া জাহাজটির উপর ফিলিস্তিনের পতাকা টাঙানো হয়েছে, যা কেবল ত্রাণ পরিবহণের প্রতীক নয়, বরং রাজনৈতিক ও মানবিক সংহতির বার্তাও বহন করে।
অতীত অভিজ্ঞতা এবং প্রতিবন্ধকতা
এই প্রথম নয়, এর আগেও গাজায় ত্রাণ পৌঁছাতে গিয়ে নানা প্রতিকূলতার মুখোমুখি হয়েছে ফ্রিডম ফ্লোটিলা। ২০১০ সালের মে মাসে সংগঠনটির অন্যতম উদ্যোগ ‘গাজা ফ্রিডম ফ্লোটিলা’ ইসরায়েলি নৌবাহিনী দ্বারা আন্তর্জাতিক জলসীমায় থামিয়ে দেওয়া হয়। এ ঘটনায় তুরস্কের ১০ জন নাগরিক নিহত হন, আহত হন বেশ কয়েকজন। ইসরায়েলি বাহিনীর দাবি ছিল, জাহাজের আরোহীরা “আক্রমণাত্মক আচরণ” করেছিল, যদিও সেই দাবি আন্তর্জাতিক মহলে ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দেয়। পরে এ ঘটনাকে যুদ্ধাপরাধ হিসেবে তদন্ত করার দাবিও ওঠে।
২০২৪ সালেও সংস্থাটি মাল্টার উপকূলে গাজামুখী একটি ত্রাণজাহাজ পরিচালনা করেছিল, যা ইসরায়েলি ড্রোন হামলার শিকার হয়। সে দফায় মিশনটি ব্যর্থ হলেও তা সংস্থার সাহসিকতাকে দমিয়ে রাখতে পারেনি।
ফ্রিডম ফ্লোটিলা: এক সংগ্রামী আন্দোলনের নাম
ফ্রিডম ফ্লোটিলা একটি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা যা মূলত সাগরপথে অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় মানবিক সহায়তা পাঠানোর জন্য পরিচিত। এই সংস্থা বিশ্বাস করে, মানবিক সহায়তা পাঠানোর অধিকার আন্তর্জাতিক আইনের অংশ এবং গাজার জনগণ এই সহায়তা পাওয়ার অধিকার রাখে। ইসরায়েলের আরোপিত নিষেধাজ্ঞাকে তারা অবৈধ ও মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন হিসেবে দেখছে।
সংস্থাটির মুখপাত্র জানান, “আমরা জানি, আমাদের যাত্রা ঝুঁকিপূর্ণ। কিন্তু আমরা চোখ বন্ধ করে বসে থাকতে পারি না, যখন গাজার মানুষ প্রতিদিন না খেয়ে ঘুমাচ্ছে, ওষুধের অভাবে মৃত্যুবরণ করছে।”
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও সম্ভাব্য ঝুঁকি
এ ধরনের মিশন প্রতিবারই ইসরায়েলের নিরাপত্তা উদ্বেগের মুখে পড়ে। ইসরায়েল আগে থেকেই বলেছে, গাজার সঙ্গে যেকোনো যোগাযোগকে তারা ‘জাতীয় নিরাপত্তা হুমকি’ হিসেবে বিবেচনা করে। ফলে এই জাহাজটিকে আটকানো বা ফিরিয়ে দেওয়ার সম্ভাবনাও নাকচ করে দেওয়া যাচ্ছে না।
ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করছে। ইউএনএইচসিআর এবং অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল জাহাজের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য ইসরায়েলকে সতর্ক করেছে এবং মানবিক সহায়তা পৌঁছাতে বাধা না দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে।
অংশগ্রহণকারীদের অবস্থান
গ্রেটা থুনবার্গ বলেন, “জলবায়ু ন্যায়বিচার আর মানবাধিকার একে অপরের সঙ্গে অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত। গাজার শিশুরা যেন নিরাপদে পানি পান করতে পারে, সেটাও জলবায়ু ন্যায়বিচারের অন্তর্ভুক্ত।”
অভিনেতা লিয়াম কানিংহামও তার অবস্থান জানিয়ে বলেন, “আমরা শুধুমাত্র সাহায্যই নয়, একট প্রতীকী বার্তাও নিয়ে যাচ্ছি—জুলুমের বিরুদ্ধে একসঙ্গে দাঁড়ানোই মানবতার প্রকৃত রূপ।”
ভবিষ্যতের পথে
ফ্রিডম ফ্লোটিলার এই যাত্রা শুধু মানবিক সহায়তা পৌঁছানোর একটি প্রয়াস নয়, বরং এটি হয়ে উঠেছে একটি আন্তর্জাতিক প্রতিবাদের প্রতীক। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম, মানবাধিকার সংস্থা এবং সাধারণ জনগণ যে পরিমাণ সমর্থন জানিয়েছে, তা বিশ্ব বিবেকের জাগরণকেই প্রতিফলিত করে।
গাজা উপত্যকার মানবিক সংকটের জন্য কেবল রাজনীতি বা কূটনৈতিক কথার প্রয়োগ যথেষ্ট নয়। এই ধরনের সাহসী ও বাস্তবমুখী উদ্যোগই পরিবর্তনের বার্তা দিতে পারে।
তবে ভবিষ্যতে এই রকম মিশন কতটা নিরাপদভাবে পরিচালিত হবে, তা নির্ভর করছে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সক্রিয় ভূমিকা এবং মানবাধিকার রক্ষায় ইসরায়েলের দায়বদ্ধতার উপর।