অর্থনৈতিক চাপে অস্থির দেশের অন্যতম বেসরকারি বিমান সংস্থা

বাংলাদেশের অন্যতম বেসরকারি বিমান সংস্থা নভোএয়ার কার্যত বন্ধের মুখে দাঁড়িয়ে রয়েছে। কয়েক বছর ধরে চলা বিপুল লোকসানের কারণে প্রতিষ্ঠানটির মালিকপক্ষ এখন এর সম্পদ বিক্রি করে দেওয়ার প্রক্রিয়ায় নেমেছে। যদিও এখনো উড়োজাহাজ চলাচল অব্যাহত রয়েছে, তবে ভবিষ্যত নির্ভর করছে এই বিক্রি চূড়ান্ত হয় কি না তার ওপর।
মালিকপক্ষের পরিকল্পনা: বন্ধ নয়, বিক্রির চেষ্টা
নভোএয়ারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মফিজুর রহমান জানিয়েছেন, তারা প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ করতে চান না। বরং সম্ভাব্য বিদেশি একটি ক্রেতার সঙ্গে বিক্রির আলোচনা চলছে। তিনি বলেন,
“আমরা আমাদের উড়োজাহাজ ও অন্যান্য সম্পদ বিক্রির প্রক্রিয়ায় রয়েছি। আমরা চেষ্টা করছি প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ না করে বিক্রির মাধ্যমে মালিকানা হস্তান্তরের।”
কোম্পানির অভ্যন্তরীণ সূত্রগুলো বলছে, একটি বিদেশি প্রতিষ্ঠান নভোএয়ারের ৫টি এটিআর উড়োজাহাজসহ অন্যান্য সম্পদ কেনার বিষয়ে আগ্রহ প্রকাশ করেছে এবং চলতি মাসেই এসব সম্পদের নিরীক্ষা করার কথা রয়েছে।
লোকসানের চাপ ও ঋণ
নভোএয়ারের বর্তমান ঋণ প্রায় ১৫০ কোটি টাকা। এর বাইরে আরও কিছু দায়দেনা রয়েছে। পাঁচটি উড়োজাহাজ ও বিভিন্ন স্থাপনা বিক্রি করে এর একটি অংশ পরিশোধ করার চেষ্টা করা হচ্ছে। যদি প্রতিষ্ঠানটি সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করতে হয়, কর্মীদের পাওনাসহ আনুষঙ্গিক খরচে ৩০ কোটি টাকার বেশি প্রয়োজন হবে বলে ধারণা করছে কর্তৃপক্ষ।
উড়োজাহাজের মেয়াদোত্তীর্ণ এবং ভবিষ্যতের ঝুঁকি
বর্তমানে নভোএয়ারের হাতে থাকা ৫টি উড়োজাহাজই কয়েক বছরের মধ্যে মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে যাবে। এর ফলে এগুলো তখন আর বিক্রি করাও কঠিন হবে। পাশাপাশি ব্যবসা চালিয়ে যেতে হলে নতুন উড়োজাহাজ কিনতে বা ভাড়ায় আনতে হবে, যা নতুন বিনিয়োগ ছাড়া অসম্ভব। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটির মালিকেরা নতুন করে বিনিয়োগে আগ্রহী নন।
১২ বছরের পথচলা এবং সংকট
২০১৩ সালের জানুয়ারিতে যাত্রা শুরু করে নভোএয়ার। এটি মূলত তুসুকা গ্রুপ ও এর উদ্যোক্তাদের উদ্যোগে চালু হয়েছিল, যাঁদের মধ্যে রয়েছেন পোশাক খাতের উদ্যোক্তা এবং বিজিএমইএর সাবেক সহসভাপতি আরশাদ জামাল, সাবেক সংসদ সদস্য ফায়জুর রহমান, ফায়েজ খান এবং মফিজুর রহমান।
প্রথমদিকে অভ্যন্তরীণ রুটে যাত্রী পরিবহন করে সুনাম অর্জন করলেও, জেট ফুয়েলের দাম বৃদ্ধিসহ নানা কারণে ধীরে ধীরে লোকসানের ঘানি বাড়তে থাকে। এতে ২০২০ সাল থেকে প্রতিষ্ঠানটি ক্রমাগত চাপের মধ্যে পড়ে।
অভ্যন্তরীণ রুট ও কর্মসংস্থান
বর্তমানে নভোএয়ার দেশের ৬টি অভ্যন্তরীণ রুটে নিয়মিত ফ্লাইট পরিচালনা করছে—ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, যশোর, সিলেট, রাজশাহী ও সৈয়দপুর। এসব গন্তব্যে প্রতিদিন একাধিক ফ্লাইট পরিচালনা করে প্রতিষ্ঠানটি।
তবে আন্তর্জাতিক রুটে (ঢাকা-কলকাতা) যাত্রী পরিবহন আপাতত বন্ধ রয়েছে।
দেশজুড়ে প্রতিষ্ঠানটির বিভিন্ন কার্যালয় ও বিক্রয়কেন্দ্রে কাজ করছেন প্রায় ৬৫০ জন। কোম্পানির ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তায় এই কর্মীদের ভবিষ্যত নিয়েও দুশ্চিন্তা তৈরি হয়েছে।
অতীত অভিজ্ঞতা: ধুঁকছে বেসরকারি বিমান খাত
নভোএয়ার যদি অবশেষে বন্ধ হয়, এটি হবে এক দশকে তৃতীয় বড় বেসরকারি এয়ারলাইনের পতন। এর আগে রিজেন্ট এয়ারওয়েজ (২০২০), ইউনাইটেড এয়ারওয়েজ ও জিএমজি এয়ারলাইনসও একই পরিণতির শিকার হয়েছিল।
বর্তমানে নভোএয়ার ছাড়া বেসরকারি খাতে কেবল ইউএস বাংলা এয়ারলাইনস এবং নতুন সংযোজিত এয়ার অ্যাস্ট্রা বিমান চলাচল করছে। অভ্যন্তরীণ রুটে রাষ্ট্রায়ত্ত বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সও ফ্লাইট পরিচালনা করছে।
নভোএয়ার বিক্রির আলোচনা যদি সফল হয়, তাহলে হয়তো সংস্থাটি নতুন উদ্যোক্তার হাতে পড়ে আবার সচল হতে পারে। তবে বিক্রি ব্যর্থ হলে, দেশ হারাতে পারে আরেকটি বেসরকারি বিমান সংস্থা। বাংলাদেশের বেসরকারি বিমান খাতের জন্য এটি হবে আরেকটি বড় ধাক্কা।
আপনার মতামত থাকলে জানাতে পারেন—বেসরকারি বিমান সংস্থাগুলো টিকতে পারছে না কেন? এর জন্য দায়ী কে—নীতি, বাজার নাকি ব্যবস্থাপনা দুর্বলতা?