অর্থনীতি

নতুন যুগের আর্থিক সঙ্গী: ক্রেডিট কার্ড নিতে যা যা প্রয়োজন

বাংলাদেশে ক্রেডিট কার্ডের জনপ্রিয়তা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। আধুনিক আর্থিক জীবনযাপনের অপরিহার্য হাতিয়ার হিসেবে ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার এখন বিরাট জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। অনলাইন শপিং, বিদেশ ভ্রমণ, দৈনন্দিন বিল পরিশোধ কিংবা হঠাৎ প্রয়োজনীয় খরচের ক্ষেত্রে এটি সহজ আর্থিক সমাধান হিসেবে বিবেচিত। তবে ক্রেডিট কার্ড পাওয়ার জন্য কিছু নির্দিষ্ট যোগ্যতা ও শর্ত পূরণ করতে হয়।

এই প্রতিবেদনটি ক্রেডিট কার্ড সম্পর্কে প্রয়োজনীয় সব তথ্য একসঙ্গে তুলে ধরেছে — কারা কার্ড পাবেন, কী কী কাগজপত্র লাগবে, ব্যাংকগুলো কীভাবে আবেদন গ্রহণ করে এবং খরচের নিয়মাবলী কীভাবে মেনে চলবেন।

ক্রেডিট কার্ড নেওয়ার যোগ্যতা ও শর্তাবলী

১. আয়ের ভিত্তিতে যোগ্যতা:
ক্রেডিট কার্ড পাওয়ার প্রথম ও প্রধান শর্ত হলো আপনার নিয়মিত আয়ের থাকা বা যথেষ্ট জমা রাখা। কোনো ব্যাংকই আয় বা আর্থিক স্থিতি ছাড়া ক্রেডিট কার্ড দেয় না।

২. চাকরিজীবীদের জন্য:
সাধারণত মাসিক বেতন কমপক্ষে ৩০ হাজার টাকা হলে ব্যাংক থেকে ক্রেডিট কার্ড পাওয়ার সুযোগ থাকে। বেতন পত্র, চাকরির প্রমাণসহ আবেদন করতে হয়।

৩. ব্যবসায়ীদের জন্য:
ব্যবসায়ীদের ক্ষেত্রে ব্যাংকে বছরে অন্তত ১০ লাখ টাকার লেনদেন থাকলে ক্রেডিট কার্ড পেতে পারেন। ব্যাংক লেনদেনের হিসাব ও আয়-ব্যয়ের প্রমাণ চায়।

৪. শিক্ষার্থীদের জন্য:
পরিবারের আর্থিক সক্ষমতার ওপর ভিত্তি করে নির্ভরশীল শিক্ষার্থীরাও ক্রেডিট কার্ডের জন্য আবেদন করতে পারেন। সাধারণত অভিভাবক বা গার্ডিয়ান ব্যাংকে রেফারেন্স দিতে হয়।

ক্রেডিট কার্ডের জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র

  • জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) — সঠিক ও বৈধ জাতীয় পরিচয়পত্র অবশ্যই থাকতে হবে।
  • দুই কপি পাসপোর্ট সাইজ ছবি — সাম্প্রতিক সময়ের ছবি জমা দিতে হয়।
  • বর্তমান ঠিকানার প্রমাণ — বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানির বিল বা অন্য কোনো সরকারি বিল হতে পারে।
  • ব্যাংক স্টেটমেন্ট — সাধারণত শেষ ছয় মাসের ব্যাংক স্টেটমেন্ট জমা দিতে হয়।
  • নমিনির পরিচয়পত্র ও ছবি — কার্ডের নিরাপত্তার জন্য নমিনির তথ্য প্রয়োজন হয়।
  • রেফারেন্স — অধিকাংশ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের একজন গ্রাহকের নাম দিতে হয় রেফারেন্স হিসেবে।

কীভাবে করবেন আবেদন?

বর্তমানে প্রায় সব ব্যাংক অনলাইনে ক্রেডিট কার্ডের জন্য আবেদন গ্রহণ করে থাকে। আবেদন করলে ব্যাংকের প্রতিনিধি বাড়ি এসে ফরম পূরণ করে নিতে পারে। আবেদন প্রক্রিয়া সম্পন্ন হলে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কুরিয়ারে কার্ড এবং পিন কোড পৌঁছে দেওয়া হয়।

অনেকে ভাবেন, ক্রেডিট কার্ড নিতে ব্যাংকে আলাদা হিসাব খোলা বাধ্যতামূলক কিনা—সাধারণত তা লাগে না, তবে কিছু ক্ষেত্রে ব্যাংক নিজস্ব নীতিমালা অনুসারে ভিন্ন হতে পারে।

ব্যাংকের যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়া

আবেদন জমা হওয়ার পর ব্যাংক আপনার ক্রেডিট স্কোর, আয়-ব্যয়ের নিয়মিততা, লেনদেন সক্ষমতা এবং অন্যান্য আর্থিক তথ্য যাচাই করে। এই যাচাই শেষে ব্যাংক সিদ্ধান্ত নেয় কার্ড প্রদানের, এবং কার্ডের ক্রেডিট সীমা নির্ধারণ করে।

ক্রেডিট স্কোর যত ভালো হবে, আপনি তত বেশি লিমিট পাবেন এবং সুবিধাজনক শর্তে কার্ড ব্যবহার করতে পারবেন।

ক্রেডিট কার্ডের ব্যবহার ও খরচের নিয়ম

ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার মানে এখন খরচ করা, কিন্তু নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ব্যাংককে টাকা ফেরত দেওয়া বাধ্যতামূলক। সময় মত পরিশোধ না করলে অতিরিক্ত সুদ দিতে হয়, যা অনেক সময় অত্যন্ত চড়া হয়।

পিন নম্বর সেট করুন: ব্যাংক থেকে পাওয়া পিন নম্বর নিরাপদে সংরক্ষণ করুন এবং কার্ড ব্যবহারের সময় সেটি ব্যবহার করুন।

বিনা সুদের সময়সীমা: মাসিক বিল কত তারিখের মধ্যে জমা দিতে হবে এবং কতদিন পর্যন্ত সুদ মুক্ত থাকবে, তা জানতে হবে। এই সময়সীমার মধ্যে বিল পরিশোধ করলে সুদ দিতে হয় না।

বার্ষিক ফি ও অন্যান্য চার্জ: প্রতিটি ব্যাংক সাধারণত বছরে এক হাজার থেকে তিন হাজার টাকা পর্যন্ত ফি কাটে। তবে বছরে নির্দিষ্ট সংখ্যক লেনদেন করলে অনেক ব্যাংক এই ফি মওকুফ করে দেয়। তাই আপনার লেনদেনের পরিমাণের ওপর লক্ষ্য রাখুন।

বাংলাদেশের ক্রেডিট কার্ডের ইতিহাস ও বর্তমান অবস্থা

বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো ১৯৯৭ সালে এএনজেড গ্রিন্ডলেজ ব্যাংক (বর্তমানে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক) ক্রেডিট কার্ড সেবা শুরু করে। এর কয়েক বছর পর ভনিক বাংলাদেশ (বর্তমানে লংকাবাংলা ফাইন্যান্স) ও ন্যাশনাল ব্যাংক এই সেবা চালু করে। এরপর ধীরে ধীরে প্রায় সব ব্যাংক ক্রেডিট কার্ড সেবা দিতে শুরু করে।

বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় ৪০টির মতো ব্যাংক বিভিন্ন ব্র্যান্ডের ক্রেডিট কার্ড প্রদান করে থাকে। বেশিরভাগ ব্যাংক ভিসা (Visa) ও মাস্টারকার্ড (Mastercard) ব্র্যান্ডের কার্ড দিয়ে থাকে। এর পাশাপাশি কিছু ব্যাংক অভিনবত্বের কারণে আমেরিকান এক্সপ্রেস (AMEX), ডিনার্স ক্লাব (Diners Club), জেবিসি (JCB) ও ইউনিয়ন পে (UnionPay) মত ব্র্যান্ডের কার্ড সেবা দিয়ে থাকে।

বিশেষ উল্লেখযোগ্য ব্যাংক ও তাদের কার্ড:

  • সিটি ব্যাংক – আমেরিকান এক্সপ্রেস (AMEX)
  • প্রাইম ব্যাংক – জেবিসি (JCB)
  • ইস্টার্ন ব্যাংক লিমিটেড (ইবিএল) – ডিনার্স ক্লাব (Diners Club)
  • ডাচ্-বাংলা ব্যাংক – নেক্সাস পে (Nexus Pay)
  • মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক – ইউনিয়ন পে (UnionPay)

ক্রেডিট কার্ড নিয়ে সচেতনতার কিছু টিপস

  • ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার শুরু করার আগে নিজের মাসিক আয়-ব্যয়ের হিসাব রাখুন।
  • অতিরিক্ত ঋণ গ্রহণ থেকে বিরত থাকুন।
  • সময়মত বিল পরিশোধ করে সুদে পরিণতি এড়ান।
  • পিন নম্বর কাউকে জানান না এবং কার্ড নিরাপদ স্থানে রাখুন।
  • অনলাইনে কেনাকাটা করার সময় নিরাপত্তা বিধি মেনে চলুন।

ক্রেডিট কার্ড এখন বাংলাদেশের আধুনিক আর্থিক ব্যবস্থার অবিচ্ছেদ্য অংশ। জীবনকে সহজ, দ্রুত আর সুবিধাজনক করতে এই কার্ডের গুরুত্ব অপরিসীম। তবে যথাযথ তথ্য ও নিয়ম মেনে সঠিক ব্যবহার করাই হল এই আর্থিক পণ্যের মূল চাবিকাঠি।

আপনি যদি ক্রেডিট কার্ড নিতে চান, তাহলে উপরে উল্লেখিত শর্তাবলী ও প্রয়োজনীয় কাগজপত্র প্রস্তুত রাখুন। ব্যাংকের নিয়ম অনুসরণ করে আবেদন করুন এবং আর্থিক স্বাধীনতার নতুন দিগন্ত খুলে দিন।

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Advertisement
Back to top button