অর্থনীতি

ডলারের বিপরীতে আরও শক্তিশালী হলো আফগান মুদ্রা

আফগানিস্তানের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ও মুদ্রানীতিতে আশাব্যঞ্জক উন্নতি

আফগানিস্তানের অর্থনীতিতে সাম্প্রতিক সময়ে ধীরে ধীরে ইতিবাচক পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। বিশেষ করে আফগান মুদ্রার (আফগানি) মান মার্কিন ডলারের বিপরীতে আরও শক্তিশালী হচ্ছে, যা দেশের আর্থিক স্থিতিশীলতার প্রতীক। দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ‘দা আফগানিস্তান ব্যাংক’ জানিয়েছে, গত এক বছরে ডলারের তুলনায় আফগানি মুদ্রার মূল্য ০.৭৯ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।

আফগান মুদ্রার এই উত্থান দেশের অর্থনৈতিক পুনর্জাগরণের অন্যতম প্রধান সূচক হিসেবে ধরা হচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে আন্তর্জাতিক আর্থিক সংকট, রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং সামাজিক পরিবর্তনের মধ্যেও আফগানিস্তান তাদের মুদ্রানীতি ও আর্থিক ব্যবস্থাকে যথাযথভাবে সামলানোর সক্ষমতা দেখিয়েছে।

আফগান মুদ্রার বর্তমান অবস্থান এবং ডলারের তুলনামূলক মূল্য

বর্তমানে মার্কিন ডলারের বিনিময়ে আফগানি মুদ্রার দাম দাঁড়িয়েছে ৬৯ আফগানি, যেখানে বাংলাদেশি টাকায় এক ডলারের মূল্য ১২২ টাকা। অর্থাৎ, ডলারের বিরুদ্ধে আফগান মুদ্রা দৃঢ় অবস্থানে রয়েছে, যা দেশের অর্থনৈতিক সাফল্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক।

আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলে অনুষ্ঠিত এক সংবাদ সম্মেলনে ‘দা আফগানিস্তান ব্যাংক’-এর প্রথম সহকারী প্রধান সিদ্দীকুল্লাহ খালিদ এই তথ্য প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, “গত বছর থেকে আফগান মুদ্রার মান বৃদ্ধি পেয়েছে, যা দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কার্যক্রমের সফল ফলাফল।”

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কার্যক্রম ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন

সিদ্দীকুল্লাহ খালিদ জানান, বিগত এক বছরে ব্যাংক পুরানো নোট ৪৮৬ কোটি ৭৮ লাখ ২ হাজার আফগানি মূল্যমানের ধ্বংস করেছে এবং নতুন নোট বাজারে ছেড়ে দিয়েছে যার মূল্যমান ৪১৫১ কোটি আফগানি। এর মাধ্যমে অর্থনীতিতে বৈধ নোটের প্রবাহ নিশ্চিত করা হয়েছে, যা মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সহায়ক হয়েছে।

তাদের আরেকটি বড় সাফল্য হলো বৈদ্যুতিক লেনদেনের পরিমাণ বৃদ্ধি। চলতি বছরে বৈদ্যুতিক লেনদেন ২৫৪২ কোটি আফগানি ছুঁয়েছে, যা আগের বছরের তুলনায় ৮৬ শতাংশ বেশি। এই উন্নত লেনদেন ব্যবস্থার ফলে আর্থিক লেনদেন আরও দ্রুত, স্বচ্ছ এবং নিরাপদ হয়েছে।

আর্থিক নীতিমালা ও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ব্যাংকের ভূমিকা

আফগানিস্তানের কেন্দ্রীয় ব্যাংক কঠোর ও যুক্তিসম্মত আর্থিক নীতি গ্রহণ করে মুদ্রার স্থিতিশীলতা বজায় রেখেছে। ব্যাংক সেদেশের অর্থনৈতিক অস্থিরতা ও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।

২০২৪ সালে আফগানিস্তানের বাজারে মোট অর্থের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪৬,০৩৫ কোটি আফগানি, যেখানে বাজারে চলমান অর্থের পরিমাণ ৩৮,৮০৩ কোটি আফগানি। ব্যাংকের এই নগদ ব্যবস্থাপনা সফলতাই দেশের অর্থনীতিকে গতিশীল করে তুলেছে।

এছাড়াও ব্যাংক নতুনভাবে সাপ্তাহিক ও মাসিক হিসাব উত্তোলনের সীমা নির্ধারণ করেছে, যেখানে আফগানি হিসাব থেকে সাপ্তাহিক ৩.৫ লাখ ও মাসিক ১০ লাখ আফগানি, এবং ডলারি হিসাব থেকে সাপ্তাহিক ৫ হাজার ও মাসিক ১৫ হাজার ডলার উত্তোলনের সুযোগ দেওয়া হয়েছে। এটি নাগরিকদের আর্থিক লেনদেনকে আরও সুবিধাজনক করেছে।

ব্যাংকের আর্থিক সহায়তা এবং আন্তর্জাতিক লেনদেনের উন্নয়ন

কেন্দ্রীয় ব্যাংক কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, ব্যাংকগুলোর আর্থিক সহায়তার পরিমাণ গত বছরে ৭১ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক মুদ্রা লেনদেনের বিভিন্ন সমস্যাও অনেকাংশে সমাধান হয়েছে।

মানি এক্সচেঞ্জার এবং আর্থিক সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রমকে স্বচ্ছ ও নিরাপদ করতে ব্যাংক তাদের কাজকে সিস্টেমেটিক এবং মেকানাইজড করেছে। ১৪৪৬ হিজরি সনের শেষ নাগাদ লাইসেন্সপ্রাপ্ত মানি এক্সচেঞ্জ ও আর্থিক সেবা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বেড়ে ১৩১২টি এবং তাদের শাখার সংখ্যা ১২৪১টিতে পৌঁছেছে।

এই পদক্ষেপগুলো দেশের আর্থিক কাঠামোকে শক্তিশালী করার পাশাপাশি অর্থনীতির স্বাস্থ্যকর পরিবেশ গড়ে তুলতে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে।

আফগানিস্তানের অর্থনীতিতে এই উন্নতির প্রভাব

আফগানিস্তানের এই অর্থনৈতিক উন্নতি শুধু দেশের আর্থিক সেক্টরে নয়, সামাজিক এবং রাজনৈতিক ক্ষেত্রে উন্নতির জন্যও আশাব্যঞ্জক। মুদ্রার মান বৃদ্ধি অর্থনীতির স্থিতিশীলতার দিকেই নির্দেশ করে, যা বিনিয়োগ বৃদ্ধি, বাণিজ্য প্রসার এবং দেশের সার্বিক উন্নয়নে সাহায্য করে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, আফগানিস্তানের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কার্যক্রম ও সুসংগঠিত আর্থিক নীতিমালা দেশকে বৈশ্বিক অর্থনীতির সাথে আরও একীভূত করার পথ প্রশস্ত করছে। এতে করে আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীদের আস্থা বাড়বে এবং দেশটি অভ্যন্তরীণ সংকট থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে।

আফগান মুদ্রার শক্তিশালী অবস্থার পেছনে কারণসমূহ

১. কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দক্ষ নগদ ব্যবস্থাপনা – ব্যাংক পুরোনো নোট পরিবর্তন এবং নতুন নোট সরবরাহের মাধ্যমে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
২. বৈদ্যুতিক লেনদেনের দ্রুত বৃদ্ধি – ডিজিটাল আর্থিক লেনদেনের বিস্তার স্বচ্ছতা এবং কার্যকারিতা বাড়িয়েছে।
৩. সংহত আর্থিক নীতিমালা – মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ এবং আর্থিক স্থিতিশীলতার জন্য নীতিমালা যথাযথ রূপায়ণ।
৪. বিনিয়োগ ও সহায়তা বৃদ্ধি – ব্যাংকগুলোর আর্থিক সহায়তার বৃদ্ধির ফলে অর্থনীতিতে গতি এসেছে।
৫. ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সিস্টেমেটিক উন্নয়ন – মানি এক্সচেঞ্জার ও আর্থিক সেবাদানকারীদের কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসা হয়েছে।

ভবিষ্যতের দৃষ্টিকোণ: আফগানিস্তানের অর্থনৈতিক সম্ভাবনা

আফগানিস্তানের অর্থনীতি ধীরে ধীরে সংকট থেকে উত্তরণের পথে। সরকারের সচেতন ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কার্যকর পদক্ষেপগুলো দেশের মুদ্রাকে শক্তিশালী করেছে, যা দেশের অর্থনৈতিক পুনরুজ্জীবনের জন্য একটি বড় ভিত্তি।

বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (IMF) এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সঙ্গে সমন্বয় সাধন করে আফগানিস্তান আগামী দিনে আর্থিক উন্নয়নে আরও অগ্রগতি করতে পারবে।

আফগানিস্তানের তরুণ ও কর্মক্ষম জনসংখ্যা, প্রাকৃতিক সম্পদ এবং কৌশলগত ভৌগোলিক অবস্থান দেশটির অর্থনৈতিক সম্ভাবনাকে উজ্জ্বল করছে। নতুন বিনিয়োগ, বাণিজ্য সম্প্রসারণ এবং অবকাঠামো উন্নয়ন ঘটলে আফগান মুদ্রার শক্তিশালী অবস্থান আরও সুদৃঢ় হবে।

আফগান মুদ্রার মূল্য বৃদ্ধির খবর শুধু অর্থনৈতিক পরিসংখ্যান নয়, এটি দেশের একটি নতুন সূর্যোদয়ের প্রতীক। ডলারের বিরুদ্ধে আফগান মুদ্রার শক্তিশালী অবস্থান দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দৃঢ় নেতৃত্ব, সঠিক নীতি এবং জনগণের আস্থার ফলাফল।

বিশ্বব্যাপী অস্থিরতার মধ্যেও আফগানিস্তানের এই অর্জন দেশের অর্থনৈতিক ভবিষ্যতের জন্য এক নতুন আশার বার্তা। আসা করা যায়, আগামী দিনগুলোতে আফগান মুদ্রার এই দৃঢ় অবস্থান দেশের সামগ্রিক উন্নয়নে বিশেষ অবদান রাখবে।

 MAH – 12006, Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Advertisement
Back to top button